১৯৭৫ থেকে
জানুয়ারি সাতাত্তর আমার কাছে ছিল স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে অনুজ্বল, সবচেয়ে মসিকৃষ্ণ
সময়কাল । ১২ইজুন ১৯৭৫, এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল নির্বাচনে অসাধু উপায় গ্রহণের
জন্য ইন্দিরা গান্ধির নির্বাচন বাতিল,তাঁর সাংসদ পদ ও বাতিল । তিনি সুপ্রিম কোর্টে
গেলেন আর এই অবসরে সময়ে নির্বাচন এড়িয়ে সংসদের মেয়াদ দুবছর বাড়িয়ে দিলেন । দেশে
প্রবল প্রতিবাদের ঢেউ । ২৫শে জুন জারি করলেন আভ্যন্তরীন জরুরী অবস্থা । সমস্ত
রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হলো, বিরোধী সব রাজনৈতিক নেতাদের কারান্তরালে পাঠালেন
ভারত রক্ষা আইন, আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা আইন বা সংক্ষেপে ‘মিসা’য়, বিনা পরোয়ানায়,
বিনা বিচারে বিরোধীদের কারান্তরালে পাঠানোর অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হলো পুলিশকে । মত
প্রকাশের অধিকার, সংবাদ প্রকাশের অধিকার, বিচার প্রার্থনার মৌলিক অধিকার লোপ করা
হলো, সংবাদ পত্র সহ পত্র-পত্রিকায় সেন্সর বিধি লাগু করা হলো । পাড়ায় পাড়ায় ইতিহাসে
পড়া ‘গেস্টাপো বাহিনী’র মত হামলা অন্য মত’এর প্রতি । নাটকের
মঞ্চে হামলা, নাট্যকর্মী খুন – সে এক বৃহন্নলা সময় – আমাদের কন্ঠনালী তাক করা
বন্দুকের নল । রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করতেও লালবাজারে উর্দিপরা লোকেদের
অনুমোদন নিতে হ’ত ।
দিনটা ছিল ২৭শে
জুন ১৯৭৫ । কারো মুখ থেকে শুনলাম আগের দিন গভীর রাতে নাকি ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা
হয়েছে । আমল দিইনি, হয়েছে তো হয়েছে, ১৯৬২তে চিন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময়ওতো
ইমার্জেন্সি জারি করা হয়েছিল শুনেছি । ভেবেছিলাম সেইরকমই কিছু হবে । চাকরী না
থাকলেও প্রতি দিনের মত সেদিনও অফিসের ক্যানটিনে আমাদের চাকরীহীন কয়েকজনের চাএর
আড্ডা চলছিল । আর্থার হাইড নামে একজন নামি হকি কেলোয়াড় ছিল । গুন্ডামি করতো, জুয়ার
তোলাবাজি করতো, কিন্তু আমাদের খুব ভালোবাসতো । হাইডকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল । ওখান
থেকেই ওর কোন চেলাকে দিয়ে আমাদের খবর পাঠিয়েছিল ‘ভাগো, ‘মিসা’ যা রহা হায়’
ইতিমধ্যে খবরের কাগজে আগের দিন রাত্রে লোকসভার প্রায় সব বিরোধী নেতাদের গ্রেফতারের
খবর জেনেছি । ‘মিসা’ বা ‘মেইনটেন্যান্স অফ ইনটারনাল সিকিউরিটি এক্ট’এর মহিমার কথাও
জেনে গিয়েছিলাম । আমরা তিনজন ছিলাম ‘হিট লিষ্ট’। যে যার ছিটকে গেলাম ।
নিজের কোয়ার্টারেতো
থাকা যাবে না, এক সহকর্মীর কোয়ার্টারে একটা ঘরে বাইরে থেকে তালাবন্ধ অবস্থায়
থাকলাম দুটোদিন । কলোনির শুকনো রাস্তায় ধুলো ওড়ানো পুলিশ জীপের হন্যেদৌড় । আমার
কোয়ার্টারে পুলিশ পরোয়ানা সেঁটে দিয়েছিল আর অফিসে জানিয়ে দিয়েছিল ‘সব সম্পত্তি
বাজেয়াপ্ত করা হ’ল’ বলে । তখন আমার সম্পত্তি বলতে ছিল তো প্রভিডেন্ড ফান্ডে পড়ে
থাকা শ’ আড়াই টাকা ! পরে সেই পরোয়ানার কপি আদালত থেকে তুলেছিলাম, লেখাছিল ‘দেশ
বিরোধী নাটক করি, আর রেলওয়ে মার্কেটটা নাকি জ্বালিয়ে দেবার ছক কষেছিলাম’ । বোঝ
কান্ড ! সেই পরোয়ানার কপিটা এখনো আমার কাছে আছে ।
বন্ধুরা বাইরে
বিকল্প রাস্তা খুজছিলেন আমাদের পালানোর ব্যবস্থা করার । পরদিন দুপুরে লুঙ্গি পরে
মাথায় একটা গামছা জড়িয়ে গ্রামীণ রাস্তা ধরে টাঙ্গা করে একটু দূরের একটা স্টেশন
থেকে একটা মালগাড়িতে গার্ডের সঙ্গে টাটানগর পৌছালাম । সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার
ট্রেনে কলকাতা । কলকাতাতো এলাম থাকবো কোথায় ? নিজের বাড়ি যাওয়া চলবে না । বন্ধুরা
খিদিরপুরের একটা মেস’এ একবন্ধুর অতিথি হয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করল । খাওয়া, বাবু
বাজারের একটা হোটেলে । খিদিরপুরের মেস’এ নানা সন্দেহের চোখ, কোথায় থাকতাম, এখানে থাকছি
কেন এই সব । তিনদিন পরে অন্য ব্যবস্থা হল বেহালায় ইস্টার্ণ রেলের চাকরি যাওয়া এক
সহকর্মীর নির্মীয়মান বাড়ির একটা ঘরে শোয়া আর অন্য এক (এখন প্রয়াত) বন্ধুর বাড়িতে
খাওয়া । সে তখন চাকরি হারিয়ে ফুটপাথে জামা কাপড় বিক্রি করতো । ফাঁকা বাড়িতে একাএকা
থাকা নিরাপদ ছিল না । পরের দিন থেকে বন্ধুর বাড়িতেই থাকারও ব্যবস্থা হ’ল । রোজ
বিকালে কার্জন পার্কে এসে মিলতাম । রোজই কেউনা কেউ বিলাসপুর থেকে আসত । দেখা হ’ত,
খবরের আদান-প্রদান হ’ত । দিনপনেরো এইভাবে চললো । জানতে পারলাম মধ্য প্রদেশের
‘মিসা’ কলকাতায় প্রযোজ্য নয় । আড়িয়াদহে বাড়ি ফিরে গেলাম । এই সময় মফঃস্বলের নাটকের
দলগুলোর সঙ্গে খুব যোগাযোগ রাখতাম । নাট্যকার অমল রায় ছিল আমার ছোট ভাইএর বন্ধু,
ওর ঘরেই আড্ডা জমাতাম । নানান যায়গায় একাঙ্ক প্রতিযোগিতার ও নাট্যোসবের নাটক দেখে
বেড়াতাম । কলকাতার ‘অভিনয়’ পত্রিকার দপ্তরেও আড্ডা জমাতাম, নাটকের খবর, ছোটখাটো
লেখা ইত্যাদি দিতাম । ব্যারাকপুরের একটা নাটকের গোষ্ঠী একটা মান্থলি টিকিট কেটে
দিয়েছিল, আমি রোজ সন্ধ্যায় রিহার্শাল দিতে যেতাম, কয়েকটা অভিনয় করেছিলাম তাদের সঙ্গে
। চাকরি নেই সুতরাং অখন্ড সময় । লাইব্রেরীর রিডিংরুমে বসে সুযোগ পেলাম প্রচুর বই
পড়ার । কয়েকটা রজনী যাত্রাভিনয়ও করেছি । বেকার নাট্যশিল্পীদের যদি কিছু রোজগারের
ব্যবস্থা করা যায় এই লক্ষ্যেই ‘মুকুন্দরাম যাত্রা সমাজ’ নামে একটা অপেশাদার যাত্রার দল বানিয়েছিলাম নাট্যকার অমল
রায়ের উদ্যোগে । সে শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটিকে যাত্রা রূপ দিয়েছিল ।
সুবিখ্যাত পালাকার ব্রজেন দের ইছাপুরের বাড়িতে যাত্রা উৎসব হ’ত । আমরা সুযোগ পেলাম
। দারুণ অভিজ্ঞতা হলো । তারপর দক্ষিণেশ্বর, চন্দন নগর ও গরিফায় অভিনয় করেছিলাম ।
গরিফায় অভিনয় চলার সময় সেকালের নয়া ‘গেস্টাপো’ বাহিনীর হামলার মুখে পড়েছিলাম ।
অভিনয় শেষ করতে দেয় নি । ওখানকার নাট্যকর্মীরা কোনরকমে আমাদের নৈহাটি লোকালে তুলে
দিয়েছিলেন ।
সময় এগিয়ে চলে ।
কর্মক্ষেত্রে বন্ধুদের সাহায্য তহবিল থেকে আসা অর্থের পরিমানও কমতে থাকে । অর্থকরী
কিছু করার জন্য চেষ্টা করি । একটা একশ’’টাকা মাইনের টিউশানি জোগাড় করলাম, আর চা
বিক্রি করতে লাগলাম । কলেজ স্ট্রীটের সুবোধ ব্রাদার্স আর বি কে সাহার দোকান থেকে
পাইকারি দরে চা কিনে, ঘরেতে ব্লেন্ড আর প্যাকেট করে ব্যাগ বোঝাই চা গার্ডেনরিচ’এ
রেলের অফিসে নিয়ে যেতাম । কিন্তু জমল না
তেমন । কিছু লোক পরের মাসে টাকা দেবেন, কিন্তু ভাবখানা এমন ছিল যেন কি বিরাট
সাহায্য করছেন কোন অভাবী লোককে, অনুকম্পার দৃষ্টি ! ছেড়ে দিলাম । কিছু দিন প্রেসের
কাজ করলাম, নাট্যগোষ্ঠীর লেটার প্যাড, ছোট কোম্পানির বিল ইত্যাদির অর্ডার নিয়ে
হ্যারিশন রোড থেকে কাগজ কিনে শিয়ালদহর প্রেস থেকে ছাপিয়ে নিতাম । খুব একটা লাভের
মুখ অবশ্য দেখিনি । ছেড়ে দিলাম । শেষে একজন মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভএর চেষ্টায়
শোভাবাজারে ছোট একটা বাঙালি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানীর অফিসে পার্টটাইম চাকরী –
মাইনে মাসে একশ’ টাকা । এই কাজটা করতে করতেই চলে এল সাতাত্তর ।
১৯৭৭এর ২১শে
মার্চ জরুরী অবস্থা প্রত্যাহৃত হ’ল । ১৬ থেকে ২০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের হ’ল ।
কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেসের একদলীয় শাসনের অবসান হ’ল । মোরারজি দেশাইএর নেতৃত্বে
জনতা পার্টির সরকার গঠিত হ’ল ২৪শে মার্চ । রেলমন্ত্রী হলেন মধু দন্ডবতে ।
রেলমন্ত্রী হয়ে প্রথম যে সরকারী কাগজে সই করেছিলেন তিনি, সেটি ছিল ভারতের সমস্ত
বরখাস্ত ধর্মঘটী রেলকর্মীদের চাকুরিতে পুণর্বহালের এর আদেশনামা ।
মাথা উঁচু করে
কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলাম । কাজে যোগ দিলাম । ‘ভারত রক্ষা আইন’ ‘মিসা’ এইসব কালা
কানুনের কোন অস্তিত্ব থাকলো না । সুতরাং বরখাস্ত হয়ে থাকা সময়ের পুরো বেতন ফেরত
পেলাম । কর্মী সংগঠনের সাহায্য তহবিল থেকে পাওয়া টাকা তাদের ফেরত দিয়ে দিলাম ।
‘পুরানো সেই
দিনের কথা’র নটেগাছ মুড়িয়ে এনেছি প্রায় । পরের পর্ব মানে শেষ পর্বে সামান্য কথা । চুরানব্বইএ
ছত্তিশগড় থেকে বাংলায় ফিরে আসা এই সব. ।
No comments:
Post a Comment