সাতাত্তরের
মার্চে চাকরি ফিরে পেলাম । কয়েকমাস পরে পশ্চিম বাংলায় বিধান সভার নির্বাচন হয়েছিল।
বিপুল ভাবে ক্ষমতায় এলো বামপন্থীরা । অ্যাকাউন্টস বিভাগে ছিলাম । একটা সর্বভারতীয়
বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ না করলে পদোন্নতি হতনা । প্রচুর পড়তে হত । এতোদিন তো
পরীক্ষা-টরীক্ষা দেবার কথা ভাবা যায় নি ! পরের বছর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, হলোনা ।
ঐসময় বাংলা অভূতপূর্ব বন্যার কবলে । অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি আর নিজেকে নিজের কথা
ভাবতে দিল না। ওখানকার চার্চএর উদ্যোগে
একটা সাহায্য তহবিল তৈরী করা হয়েছিল । তখনতো আর ‘আমাদের বন্যা’ ‘ওদের বন্যা’ কিংবা
‘ম্যানমেড বন্যা’ এই রকম যুগান্তকারী আবিস্কার হয়নি ! ‘ভাঁড় মে যায় প্রমোশনের
পরীক্ষা’ বলে ঝাপিয়ে পড়লাম । মনে আছে মহালয়ার দিন বোম্বে মেলএ হাওড়া থেকে ফিরছিলাম
। রাত্রি আটটা নাগাদ প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল, ট্রেন তখন বাগনান স্টেশনের কাছাকাছি
। কতক্ষণ ধরে বা কতদিন ধরে সেই অঝোর বৃষ্টি চলেছিল তা আর মনে নেই । ক’দিন পরেই
খবরের কাগজ আর রেডিও সব জানালো । দুবছর পরে পরীক্ষা দিলাম, পাশ করলাম । রেল একটা সুযোগ
পেলো বদলি করে দেবার । রায়পুরে একটা ছোট অফিসে বদলি করে দিল । দুশ’ কর্মীর অফিস
থেকে সাতজন কর্মীর অফিসে রায়পুরে চলে এলাম ।
সাতাত্তরে বাংলায়
বামফ্রন্টের শাসন শুরু হ’ল । নিয়ম মাফিক পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন, বামপন্থীদেরই
ফিরে আসা ইত্যাদি । এরপর বলার মত কোন তরঙ্গ আমার মধ্যবিত্ত জীবনে আসেনি । যা কিছু
সবই ব্যক্তিগত যোগ-বিয়োগ,তাতে কারো আগ্রহ থাকার কথা নয় ।
হ্যা, একটা
বৃত্তান্ত বলা যেতে পারে । সম্ভবত ১৯৮৪ হবে । চক্রধরপুর- নাগপুর প্যাসেঞ্জারে আগুন
লেগে ৫৬জন পুড়ে মারা গিয়েছিল । ওটা ৫৭জনও হতে পারতো, হয়নি । হঠাত যাওয়া,
রিজার্ভেশন করে ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়া যাবেনা ভেবেছিলাম । সকালে বাজার করতে যাবার
সময় রিজার্ভেশন কাউন্টারে উঁকি মারলাম । একটা বার্থ খালি ছিল, পেয়ে গেলাম । বাড়িতে
বা অফিসে সকলে জানতো সেকন্ড ক্লাসেই যাচ্ছি । রাত্রি দুটো নাগাদ রাজনন্দ গাঁও
স্টেশন পেরিয়ে লোকের চ্যাঁচামেচিতে ধড়মড় করে ঊঠে পড়লাম । ট্রেনে আগুন লেগেছে । কোন
রকমে সঙ্গের ব্রিফকেশ টা নিয়ে লুঙ্গি পরেই জঙ্গলের মধ্যে লাফিয়ে পড়লাম । শীতের
রাতে আমরা কয়েকশ’ লোক মানুষ পোড়ার গন্ধ সহ্য করে ট্রেনের তিনটে কামরা পুড়ে খাক হয়ে
যাওয়ার সাক্ষি থাকলাম । ওই কামরাগুলোর একটাতে আমারও থাকার কথা ছিল । ভেবেছিলাম
হয়তো অফিসে শোকসভার চাঁদা তোলা শুরু হয়ে গেছে । যাইহোক কয়েক ঘন্টা পরে রিলিফ ট্রেন
এলো । আমি নাগপুরে পৌছে বাড়িতে বেঁচে থাকার খবরটা জানালাম ফোন করে ।
১৯৯৪এ ইচ্ছা হ’ল
এবার জন্মস্থানে ফেরা যাক । একত্রিশ বছর তো ছত্তিশগড়ে কাটালাম ! কোনদিন ফেরার কথা
ভাবিনি । কে এম ডি এ তে ডেপুটেশনের প্রস্তাব এলো । ওরা তখন একাউন্টস অফিসার
ডিফেন্স বা রেল থেকে ডেপুটেশনে নিতো । পেয়ে গেলাম । ১৯৯৪এর ২৫শে সেপ্টেম্বর
প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে ছত্তিশগড়ের পাট চুকিয়ে ফিরে এলাম । দুবছর কে এম ডি এ তে কাজ করে
আবার রেলের হেড অফিসে (গার্ডেনরিচ) ফিরলাম । ২০০২এর ১লা এপ্রিল থেকে অবসর জীবন,
অবসর মানে গোলামি থেকে ।
অবোধ শৈশবে
বিদেশী শাসনের অবসান দেখেছি, একচ্ছত্র কংগ্রেস শাসনের অন্ত হওয়ার সাক্ষি থেখেছি,
বামপন্থী শাসনের উথ্বানের তাপ-উত্তাপ গায়ে মেখেছি, আবার সেই কুখ্যাত প্রদীপ
কুন্দলিয়ার বহুতল ধ্বসে পড়ার মত সেই শাসনের অন্তও দেখেছি ।
সেপ্টেম্বর
চুরানব্বই থেকে কলকাতা নামক মহাসমুদ্রে । কে কার খবর রাখে ! ৯৮এর ২৩শে মার্চ অফিস
থেকে ফিরছিলাম । পাড়ায় তখনকার সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে
দেখলাম কয়েকজন বেশ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী টেলিভিষণে ‘জন্মভূমি’ সিরিয়াল দেখছে । সেইদিনই
ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ মারা গেছেন, সংবাদ জেনেছি । চকিতে মনে পড়ে গেল চুয়াত্তরের
২৩শে জুলাই হরেকৃষ্ণ কোঙারের মৃত্যুর পর আমার এক কেরালিয়ান সহকর্মী হাউ হাউ করে
কেঁদেছিল ।
পরিণত বয়সে মাঝে
মাঝে নিজেকে জিজ্ঞাসা করি দেখলেতো অনেক, কি শিখলে হে ? শিখেছি বৈকি ! সেই গ্রীক
রূপকথা ইউলিসিসি’এর সারাৎসার ‘যতক্ষণ তোমার পা মাটিতে ততক্ষণই তুমি প্রবল শক্তিধর’
।