Total Pageviews

Monday, September 21, 2015

আমার কথা - তিন



একটা তেরো টাকা দামের রেক্সিনের স্যুটকেশ, পকেটে তিরিশটা টাকা আর একটা সতরঞ্চি সঙ্গি করে হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিয়েছিলাম । রেল একটা পাশ পাঠিয়ে দিয়েছিল এপয়েন্টমেন্ট লেটারের সঙ্গে । দুজন খুব কাছের বন্ধু হাওড়া স্টেশনে এসেছিল তুলে দিতে তাদের একজনের বাবার ট্যাক্সি ভাড়া খাটতো । সেদিন রাস্তায় বেরোয় নি, আমাকে নিয়ে এলো তাদের গাড়ি করে । আর একজন দুপ্যাকেট পানামা সিগারেট কিনে দিল । রাত্রি আড়াইটা নাগাদ বোম্বাই এক্সপ্রেস বিলাসপুর পৌছালো । প্ল্যাটফর্মে সতরঞ্চিটা বিছানোর একটা যায়গা পেয়ে গেলাম। দেখলাম আরো দুএকটা সতরঞ্চি বিছানো হচ্ছে । ব্যস ওখান থেকেই নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ শুরু হ’ল । একই পথের পথিক তোআর একা থাকলাম না। তিনজনে মিলে ‘আমরা’ হয়ে গেলাম ।

রেলের বাজারে একটা বাঙালি হোটেলে ৬০ পয়সায় মাছভাত খেয়ে অফিসে রিপোর্ট করলাম । পুরানো লোকেরা অনেক ভালোবাসা দিলেন । বড় ডিভিসনাল অফিস, অনেক লোক কাজ করেন সত্তর ভাগ বাঙালি আর তিরিশ ভাগ দক্ষিণ ভারতীয়, সবাই কলকাতা বা খড়গপুর থেকে বদলি হয়ে গেছেন ওখানে । বাঙ্গালিদের দল ভারি হল – আদরতো পাবোই । মেডিক্যাল হতে দিন তিনেক লাগলোপ্রথমে সপ্তাখানেক শোয়ার ব্যবস্থা হ’ল যাযাবরের মতো – মানে কেউ ছুটিতে গেছেন তার কোয়ার্টারে শুয়ে ঘর পাহারা দেওয়া । পরে একটা মেসে ঢুকে গেলাম । একটা রেল কোয়ার্টারে আরো ৪/৫ জনের সঙ্গে ভাগ করে থাকা, দশটাকাকা দিয়ে কেনা একটা দিড়ির চারপাইএ শোয়া, আর অন্য একটা মেস’এ খাওয়া কুড়ি জনের মত একসঙ্গে । ২৩ বছর বয়স – ছাড়া গরুর মতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা বলার মত কেউ নেই, ওটা কোরনা বলার মত কেঊ নেই, শুধু নিজের জন্য কিছু ভাবার মত মনটাও তৈরী হয় নি ।

নাটকের দল করা, রেলকলোনির রিক্রিয়েশন ক্লাব লাইব্রেরী, সাংস্কৃতিক সামাজিক কাজকর্ম, মৃতদেহ সৎকার, হাসপাতালে রাত জাগা , কাজের বাড়িতে পরিবেশন করা এইসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আর  এইসব করার সুবাদে প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলাম । মায়ের মত, নিজের বড় দাদার মত ভালোবাসা মানুষের ওষ্ঠ থেকে তার বিষদ-বিন্দু শুষে নিতে চাওয়ার মধ্যে, আর একজনের চকচকে চোখ দেখতে পাওয়ার মধ্যে যে কি আনন্দ, কি সুখ তার তো কোন লিখিত শব্দ হয় না ! মা ভাই বোন ছেড়ে দূরে থাকার কোন কষ্টই সেইসব মানুষেরা আমাকে পেতে দেননি । থিয়েটার আর কবিতার আবৃত্তি খুব করতাম সামান্য যা লেখালেখির চর্চা করতাম তা গদ্য । কবিতা লেখার চেষ্টা করিনি কোন দিন, ইচ্ছেও হতো না হাংরি জেনারেশন না কিসব বলতো নিজেদের, ওদের কবিতা কয়েকটা পড়ে আধুনিক কবিতার ওপরই একটা বিতৃষ্ণা এসেছিল, ওগুলোকে ‘অন্ধকারের জীবন বেদ’ মনে হতো ।

১৯৬৭ তে সারা ভারতে প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া জাতীয় কংগ্রেসের সারা ভারতে একচ্ছত্র শাসনের টালমাটাল অবস্থা, পশ্চিম বাংলাতেও প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার করলো অজয় মুখার্জীর মুখ্যমন্ত্রীত্বে, বছর না পেরোতেই রাষ্ট্রপতি শাসন জাতীয় কংগ্রেসের একচ্ছত্র শাসন অবসানের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ থেকেই । সেই উত্তাপে শরীর সেঁকেছিলাম আমরা অনেকেই, দূরে থেকেও

১৯৬৮র ১৯শে সেপ্টেম্বর রেল সহ কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারিদের সংগঠনগুলি একদিনের টোকেন স্ট্রাইক ডাকলো । স্ট্রাইক বে-আইনী ঘোষণা করলো সরকার । তো কর্মচারীদের স্ট্রাইক আবার কবে আইনী হয় ! আমার চাকরির বয়স তখন সবেমাত্র তিন বছর সাত মাস দাবি ছিল প্রয়োজন ভিত্তিক ন্যুনতম বেতন । ‘চল পানসি বেলঘরিয়া’, ‘যো হোগা দেখা যায়গা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ধর্মঘটে । ‘ব্রেক ইন সার্ভিস’ হ’ল , মানে আমার চাকরি জীবনের একটা দিন মাইনে সহ বাদ হয়ে গেলো । সেই একটা দিন এবং একদিনের বেতন আর ফিরে পেলাম না । বার্ষিক মাইনে বাড়ার বা ইনক্রিমেন্ট’এর দিনটাও পিছিয়ে গেলো একদিন । সার্ভিস বুকে প্রথম লালকালির দাগ পড়লো , তা পড়ুক । চাকরির তিন বছরের মাথায় এই শাস্তি যে আমাকে দমিয়ে দিয়েছিল তা নয় বরং আরো কঠিন করেছিল মানসিক ভাবে ।


খবরের কাগজে আজ দেখলাম । ১৯৭৪এর পর ভারতীয় রেলের ১৩লক্ষ কর্মচারী লাগাতার ধর্মঘটের নামতে চলেছেন । নব্বইভাগ রেলকর্মচারীই ধর্মঘটের পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন । ১৯৭৪এর সেই সময় এবং ঠিক একবছর পরে সেই কৃষ্ণপ্রহর ১৯৭৫এর জরুরী অবস্থাকে ছুঁয়ে যাবো পরের পর্বে ।

No comments:

Post a Comment