১৯৬৯ । শোনা গেলো বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ । তরাইএর কৃষক
আন্দোলন আর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়লো সারা বাংলায় । দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টও ভেঙ্গে গিয়ে
শুরু হ’ল রাষ্ট্রপতি শাশন । কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্বল তরুণরা ঝাঁপপিয়ে পড়লো সেই অগ্নি সময়ের অচেনা আহ্বানে । প্রবল শক্তিধর রাষ্ট্রযন্ত্রের
বিরুদ্ধে । ঘরে ১৮বছর বয়সী সন্তান থাকলে মা-বাবার দুশ্চিতার অন্ত থাকতো না । তাদের
বাড়ির বাইরে গেলে ঘরে ফেরা নিশ্চিত ছিল না । গুপ্তহত্যা, জেলখানায় হত্যা, কলকাতার গলিতে ছড়িয়ে থাকা তরুণের মৃতদেহ
ডিঙ্গিয়ে মানুষ অফিস-কাছারি করছেন, বরানগর কাশিপুরে লরিভর্তি মৃতদেহ পাচার হয়েছিল
। সামনে একাত্তরের ভোট ছিল । সেসব কথা না ছোঁয়া দূরত্বে থাকলেও তার গনগনে আঁচ সাতাশ বছরের আমাকে রেহাই দেবে কেন ? কাকেই বা
দিয়েছিল ?
বছরে দুতিনবার বাড়ি যেতাম । চুটিয়ে নাটক দেখতাম ছোট
দলগুলির নাটক । প্রতিষ্ঠান বিরোধী, বেশ রক্ত গরম করা নাটক । কার্জন পার্কে কত
আনামি গোষ্ঠী মঞ্চ ছাড়াই ছোট ছোট নাটক করতো,কলকাতায় এলে দেখতাম । বোধয় একাত্তরের
জুলাই মাস হবে, প্রবীর দত্ত নামে কার্জন পার্কে নাটক দেখতে আসা এক তরুণ পুলিশের
গুলিতে মারা গিয়েছিল । সেই সময় আমরা বিলাসপুরে একটা সর্বভারতীয় বাংলা একাঙ্ক
নাটক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম বাংলার জেলা শহরের নাট্যগোষ্ঠীগুলি আসতো । এখানকার
নাট্য আন্দোলনের ঢেউ আমাদের ওখানেও আছড়ে পড়ে । আমিও তরুণদের নিয়ে নাটকের দল করে
নাগপুর, জব্বলপুর,জামশেদপুর, আদ্রা, ভিলাই এরকম কতযায়গায় গিয়েছি । ১৯৭২এর কোন মাস
মনে নেই ১৭/১৮ বছর বয়সী থিয়েটারে আনকোরা এক
তরুণকে একটা নাটকে অভিনয় করাই । তারপর
ছেলেটিকে আর খুঁজে পাই নি । এই কদিন আগে ঢাকা থেকে আমাকে খুজে পেলো ফেসবুকে । চল্লিশ বছর পরে প্রবল উচ্ছাসে
মেসেজ করে জানালো দাদা আপনার কাছ থেকে সতেরোটা টাকা নিয়েছিলাম, ফেরত দেওয়া হয়নি মনে আছে । কি
বিস্ময়কর খুঁজে পাওয়া প্রিয় মানুষকে ! সময় অনেক কিছু কেড়ে নেয় বটে, আবার ফিরিয়েও
দেয় কিছু না কিছু ! কলকাতার ‘অভিনয়’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় দূরের মঞ্চে বাংলা নাটকের
খবর লিখতাম নিয়মিত । ‘রঙ্গমঞ্চ’ নামে একটা ছোট নাট্য পত্রিকায় সংযুক্ত সম্পাদক হয়ে
যুক্তও ছিলাম ১৯৭৫ পর্যন্ত ।
চুয়াত্তরের গোড়ায় রেলকর্মীদের ‘স্ট্রাইক ব্যালট’ আহ্বান
করলো রেলের ইউনিয়ন । সারা ভারতে নব্বই ভাগেরও বেশি রেলশ্রমিক লাগাতার ধর্মঘটের
পক্ষে মত দিল । প্রধান দাবী ছিল ‘ওয়েজ প্যারিটি’ বা সমান কাজে সমান বেতন ও সকলের
জন্য বোনাস । ৮ইমে ১৯৭৪ থেকে সারা ভারতে লাগাতার রেল ধর্মঘটের ব্যাপক প্রস্তুতি
শুরু হলো । বিভিন্ন রেল শ্রমিক সংগঠনগুলিকে একটা কেন্দ্রীয় কমিটির আওতায় নিয়ে এসে
তৈরী হয়েছিল ‘ন্যাশানাল কোওর্ডিনেশন কমিটি ফর রেলওয়ে মেনস স্ট্রাগল’ বা এন সি সি
আর এস । সম্ভাব্য দমন পীড়ন মোকাবিলার জন্য অর্থ সংগ্রহ, রেলকলোনিগুলোতে কর্মীদের, তাদের
বাড়ির মহিলাদের মিছিল ইত্যাদি হতো । সে এক অগ্নিগর্ভ দিন । একত্রিশ বছরের আগুণখেকো
আমার চাকরীর বয়স তখন সবে নয় বছর । সবাই ধর্মঘটে সামিল হবেন না জানতাম কিন্তু তাদের
নৈতিক সর্থন ছিল রেলকর্মীদের পরম ভরসার যায়গা ।
ধর্মঘট শুরুর দিন এগিয়ে এলো । ধর্মঘট বে-আইনী ঘোষণা করলো
সরকার । পয়লা মে ‘মে দিবসে’র মিছিল ছিল শহরে । আমি যাইনি । জানতে পারলাম প্রথম
সারির রেলকর্মীদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ । বাংলা নাটক আর কবিতা চর্চা করা আমার মত বাউন্ডুলে ছেলে ছত্তিশগড়
পুলিশের ‘হিট লিস্ট’এ ঢূকে গিয়েছিলাম কিকরে, বুঝতে পারি নি । ৫ই মে বন্ধুদের সঙ্গে
একসাথে অফিস যাচ্ছিলাম । ডিআরএম অফিসের সামনে থেকে আমাকেও গ্রেপ্তার করলো পুলিশ ।
জেলখানার লাপসি খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেলো । আমাদের সঙ্গে একই সেল’এ ছিলেন এখনকার বেশ
বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা শরদ যাদব । ও তখন জব্বলপুরের ফায়ারব্রান্ড ছাত্রনেতা,
স্যোশালিস্ট পার্টির । শরদকে আর রেলকর্মী বন্ধুদের রোজই শোনাতাম নাজিম হিকমতের
জেলখানার চিঠি কবিতাটা, “মানুষের মুন্ডুটাতো বোঁটার ফুল নয় যে ইচ্ছা করলেই ছিঁড়ে
নেবে” ! জেলে থাকতেই শুনেছিলাম ভারত নাকি রাজস্থানের ‘পোখরান’এ তার প্রথম আনবিক
পরীক্ষা করেছে । উনিশ দিন চলেছিল রেল ধর্মঘট । উনিশ দিনের মাথায় ভেঙ্গে গিয়েছিল । দেশের
নানা প্রান্তে অভূতপূর্ব দমন-পীড়ন নেমে এসেছিল ধর্মঘটী রেল শ্রমিক আর তাদের
পরিবারের ওপর । এখনকার প্রজন্মের মানুষদের শিঊরে ওঠার মত উপাদান ছিল সেই পীড়নে । জানিনা তারা কতটুকুই বা জানেন
রাষ্ট্রের সেই বে-নজির প্রতিহিংশার কথা । রেলের কারখানাগুলিতে ধর্মঘটের প্রভাব ছিল
বেশি । দেশের অনেক যায়গায় রেলকলোনির ধর্মঘটী পরিবারের কোয়ার্টারে বিদ্যুৎ আর জল
সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল, তাদের সন্তানদের রেলের স্কুলে ভর্তি নেয়নি ।
২৭শে মে ধর্মঘট ভেঙ্গে গেলো । আমরা জেল থেকে ছাড়া পেলাম
আরো দিন তিনেক পরে । চাকরিতে জয়েন করতে দিল না । জানলাম বে-আইনী ধর্মঘটে অংশ
নেওয়ার জন্য চাকরি ‘ঘ্যাচাং’ হয়ে গেছে । সারা ভারতে হাজার হাজার রেল কর্মচারির
চাকরি চলে গিয়েছিল । রাষ্ট্রের সে এক অভূতপূর্ব প্রতিহিংশামূলক
পীড়ন তার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে । তবুও নতজানু হয়নি তারা । অফিসে আমার শুভাকাঙ্খী
দাদারা যারা ধর্মঘট থেকে বিরত ছিল, তখনকার বেশ কেউকেটা মন্ত্রী সম্প্রতি প্রয়াত
বিদ্যাচরণ শুক্লার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল । ওর কাছে গিয়ে বলতে হবে, কম বয়স, ভুল
করে ফেলেছি, আর বেয়াদব হবো না, এইরকম ।
দেশের প্রথম সারির আইনবিদরা রেলকর্মীদের পক্ষে আদালতে
দাঁড়িয়েছিলেন । আমার মামলাটা কলকাতা হাইকোর্টে লড়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় । মনে
আছে, অমিয় কুমার মুখার্জীর ঘরে দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে বরখাস্ত করার রেলের হুকুমনামা
খারিজ হয়ে যায় । ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন না নিয়ে কারো চাকরি খেয়ে নেওয়া যায় না । সেই
প্রথম আমার হাইকোর্ট দেখা । মামলা খারিজ হলেও চাকরি ফেরত পাইনি তখন । অবাস্তব সব অভিযোগ এনে ‘মেজর পেনালটি চার্জশীট’ ধরিয়ে দেয় অর্থাৎ যেভাবেই
হোক দোষী সাবস্ত করে চাকরী খাওয়ার বন্দোবস্ত । তবে হ্যাঁ, আত্মপক্ষ সমর্থনের
সুযোগ পেয়েছিলাম । সেই শুনানি আর শেষ করতে পারে নি রেল । ‘নির্যাতিত রেলকর্মী
তহবিল’ থেকে অর্থ সাহায্য পেতাম, চলে যেত বা চালিয়ে নিতে হতো । কর্তৃপক্ষের বিনা
অনুমতিতে বাড়ি যেতে পারতাম না, অনেক দিন রেলের পাস’এর তোয়াক্কা না করেই কলকাতা চলে
যেতাম । রেলের মুখচেনা টিটি, তারা নিয়ে যেতো । কোনদিন আবার প্যান্ট্রি কারের
ম্যানেজারের কোচে মুরগির ঝোল ভাত খেয়ে তাদের সঙ্গেই চলে আসতাম ।
বছর শেষ হ’ল । এলো স্বাধীন ভারতের চবচেয়ে মসিকৃষ্ণ
কালখন্ড । জারি হয়েছিল জরুরী অবস্থা ।
‘মিসা’ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বেপাত্তা
হয়ে গেলাম রেল কলোনি থেকে । সাতাত্তরে চাকরি ফিরে পেলাম । বলবো পরের পর্বে ।
No comments:
Post a Comment