Total Pageviews

Monday, September 21, 2015

আমার কথা - এক



জন্মেছিলাম ১৯৪২এর মার্চ’এ । মানে স্বাধীনতার দিন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন । স্বাধীনতার দিনটার কথা মনে নেই , কিন্তু পরের বছর গান্ধীজির মৃত্যুদিনের কথা একটু একটু মনে আছে ।  আর মনে আছে – কি করে মনে আছে কে জানে, যুদ্ধজনিত কারণে দোকানে চাল ডাল অমিলের কথা । বাবার কোলে চেপে রেশনের দোকানে অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়ানোর কথাও খুব হালকা করে মনে পড়ে । খুব প্লেনের আওয়াজ শুনে ভয় পেতাম, মনে হতো এরোপ্লেনগুলো খুব নীচু দিয়ে যাচ্ছে । যুদ্ধ থেমে গেলেও এরোপ্লেনের আনাগোনা , সেনাদের প্যারেড এইসব ছিলই । প্লেন অবশ্য খুব কাছ থেকেই দেখেছি । আমাদের আড়িয়াদহের বাসা থেকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার পথে একটা মিলিটারি আস্তানা এখনো আছে । ওটা আগে ছিল ব্রিটিশ সেনাদের ক্যাম্প । এরোপ্লেনের রানওয়েটা এখনো আছে । তখন ইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি, অনেক কিছু দেখছি, বুঝতে শুরু করেছি । দেশ ভাগ, দাঙ্গা, এইসব উত্তেজনা তখন আমার গায়ে লাগার কথা নয়, কিন্তু মনে আছে পাড়ার দাদারা বলাবলি করতো কামারহাটি থেকে একদল মুসলমান নাকি আসবে । দাদারা লাঠি-সোটা নিয়ে পাড়া পাহারা দিতো । আমরা ঘরের মধ্যে সিটিয়ে থাকতাম  দরজা জানালা বন্ধ করে । সাতচল্লিশ-আটচল্লিশে জিনিস-পত্রের দাম মনে নেই কিন্তু ৫২/৫৩ সালের কথা মনে আছে , তখন অল্পসল্প দোকান বাজার করছি ১০ বছর বয়সে । মনে আছে একমন চালের দাম হয়েছিল ১৬টাকা । একমন মানে ৪০ সের, এখনকার সাড়ে সাইত্রিশ কেজি। পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা অনেক পরে বইএ পড়ে ফেলে ভেবেছি আমিও তবে ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি’র দলে ? ‘দমদম দাওয়াই’এর কথা খুব ভালো মনে আছে, সেটা বোধয় আরো পরে ৫৭/৫৮সাল হবে । কৃত্তিম ভাবে মজুত করে, জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিতো মজুতদারেরা । মজুতদারদের বাধ্য করা হতো মজুত মাল বিলি করে দিতে । দমদমে প্রথম হয়েছিল বলে খবরের কাগজে বলতো ‘দমদম দাওয়াই’। তারপর অনেক যায়গায় এইরকম লুটপাট হতো ।

খুব মিছিল হ’ত । একটা স্লোগান খুব মনে আছে মুখে একটা চোঙ্গা লাগিয়ে, একজন বলতো ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ আর বাকি লেকেরা একসঙ্গে বলতো ‘ভুলো মাত, ভুলো মাত’ । ৯/১০ বছরে আমিও দুএকটা এইরকম মিছিলে হেঁটেছিলাম, মনে আছে । বুঝতামনা কিছু, কিন্তু ভালো লাগতো, বেশ উত্তেজনা বোধ করতাম । এই উত্তেজনার মধ্যে চলে এটে১৯৫২র প্রথম সাধারণ নির্বাচন । বলার মত কিছুই মনে নেই । শুধু মনে আছে মা ভোট দিতে গিয়েছিল । যে ইস্কুলে ভোট হচ্ছিল সেখানে যেতে, লোকেরা নাকি বলেছিল আপনার ভোট হয়ে গেছে । অবাক মা বাড়ি ফিরে বলেছিলো ‘আমি ভোট দিলাম না আর বলে দিল ভোট হয়ে গেছে’ ! তো তারপর মা’কে আর কখনো ভোট দেওয়ানো যায় নি । দশবছর বয়সের স্মৃতি চৌষট্টি বছর পরে এইটুকুই মনে আছে । 

বয়স বাড়ে,খবরের কাগজ পড়ি । দৈনিক বসুমতি নেওয়া হত বাড়িতে । খুব মিছিল মিটিং হতো । শুনতাম । একজনের নাম খুব শুনতাম । বুঝি না বুঝি তাঁর মিটিংগুলো আমাকে টানতো । জ্যোতি বসু । আমাদের এলাকারই এম এল এ । মিটিংএর ভাষণ তত বুঝতাম না । কিন্তু তার বলার আগে ছোট ছোট নাটক আর গান হত , বেশ উদ্দীপনা লাগতো । গান গাইতো গণনাট্য সঙ্ঘের লোকেরা । তারও আগে, মনে আছে একটা অনুষ্ঠানে শম্ভু মিত্রর নিজকন্ঠে ‘মধু বংশীর গলি’ আর শম্ভু ভট্টাচার্যর ‘রানার’ ব্যালে নাচ দেখেছিলাম । ছাড়া গরুর মতো ঘুরছি । অবশ্য স্কুলেও যেতাম । জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে, বাজার করার টাকা থেকে হাতসাফাই করে ছ আনা পয়সা জমলেই সিনেমা দেখতে ছুটতাম । পাঁচ আনায় সবচেয়ে কম দামের টিকিট আর চার পয়সায় উত্তরপাড়ায় যাওয়া আসার নৌকার ভাড়া । কিংবা বালির ব্রীজ দিয়ে হেঁটে । বালির ব্রীজ (তখন নাম ছিল ওয়েলিংডন ব্রীজ) পেরনোর জন্য দু পয়সা টোল ট্যাকস লাগতো । ১২/১৩ বছর বয়স থেকেই সিনেমা দেখার খুব নেশা হয়েছিল আর নেশা ছিল গান শোনা । খুব গানের জলসা হতো, হেমন্ত মুখার্জী বোম্বাই থেকে গান গাইতে আসতেন ।  আর তখনকার সব ছোট বা বড় জলসায় জহর রায়,ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়দের হাস্যকৌতুক হ’ত । আট আনা বা একটাকার টিকিট কাটার পয়সা পাবো কোথায় ? চট ঘেরা প্যান্ডালের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতাম । অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে মাথায় একটা চাঁটি মেরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতো । দুপয়সা পেতাম জল খাবারের জন্য । এক পসার মুড়ি আর এক পয়সার মুড়কি । বাজার করার খুব উৎসাহ ছিল কারণ দু এক পয়সা বাঁচিয়ে নিজের পকেটে ঢোকাতে পারতাম । সেইজন্যই বোধয় মনে আছে একটাকা দিতো বাজার করতে । ছ’আনায় মাছ নিতাম, দেড়পোয়ার মত মাছ কিনতাম মনে হয় । বাকি দশ আনায় অন্য সবজি কিনে চা্র পাচ পয়সা ফেরত দিতাম ।

১৯৫৭র এপ্রিল থেকে টাকা পয়সা, ওজন এইসবের জন্য দশমিক পদ্ধতি চালু হল। মানে, এক,দুই পয়সা, এক আনা, চার আনা, আট আনা, আর ষোল আনায় একটাকার বদলে একশ’ পয়সায় একটা টাকা,আর ছটাক, পোয়া, সের উঠে গিয়ে কিলোগ্রাম চালু হ’ল । চালু হওয়ার পর অনেক দিন বলতাম নয়া পয়সা ।

পড়াশুনায় খুব আহামরি ছাত্র ছিলাম না । নাটক, আবৃত্তি , দেওয়াল পত্রিকা এইসব করছি, গর্কির ‘মা’ পড়ে নিয়েছি ক্লাস এইটএ, উৎপল দত্তর ‘অঙ্গার’ দেখা হয়ে গেছ, প্রথাগত পড়াশুনায় আর কতটা ভালো হওয়া যায় ! কিন্তু স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাটা পাশ করে গেলাম । পরীক্ষার দিন পনেরো আগে পক্স বেরোলো , আমি বিছানা নিলাম । পরীক্ষা কি করে দেবো ভেবে কান্নাকাটি করলাম । সাগর দত্ত হাসপাতালে সিক বেডে পরীক্ষার ব্যবস্থা হ’ল । ব্লিচ করা খাতায় পেন্সিলে লিখতে হল । পাশ করে প্রি-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজে । তখন উচ্চ মাধ্যমিক চালু হয় নি । দশ ক্লাস পাশ করেই কলেজ । স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর থেকেই চাকরির চেষ্টা চালাতে লাগলাম । তখন সরকারি চাকরী পাওয়ার বয়স সীমা ছিল ২৩ বছর । একদিন দেখলাম খবরের কাগজে রেলে প্রচুর লোক নেওয়ার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে । দুটাকা দিয়ে একটা ফর্ম কিনে ভর্তি করে বসে থাকলাম । পরীক্ষার ডাক এলো । কিন্তু পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেলো । পরীক্ষা ছিল মির্জাপুর স্ট্রীটের সিটি কলেজে । মনে আছে সেদিন খুব দাঙ্গা হয়েছিল । সিটি কলেজ থেকে শিয়ালদহ আসার পথে দেখেছিলাম হ্যারিশন রোডের অনেক দোকান আগুনে জলছিল । কিছু দোকানের সাটারে খড়ি দিয়ে লেখা ছিল হিন্দুর দোকান । সেগুলোয় আগুন লাগে নি । পরীক্ষা পিছিয়ে পরের রবিবার হয়েছিল । দিলাম । ইনটারভিউএ ডাকলো, দিলাম । তারপর তিনবছর পরে চাকরির চিঠিটাও এসে গেলো । মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে রেলের একাউন্টস ক্লার্কের পদে চাকরির ডাক পেলাম  ১৯৬৪র নভেম্বরে । তখন বিকম পার্ট ওয়ানটা পাশ করেছি, পার্ট টু দিয়ে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করা গেলোনা (পরে চাকরী করতে করতে পরীক্ষা দিয়েছিলাম)। একটা তেরো টাকা দামের রেক্সিনের স্যুটকেশ, একটা সতরঞ্চি সঙ্গি করে রওনা দিলাম নতুন জীবনের ডাকে সাড়া দিয়ে ।


No comments:

Post a Comment