Total Pageviews

Sunday, October 11, 2020

আমার কথা - ৬

 সাতাত্তরের মার্চে চাকরি ফিরে পেলাম । কয়েকমাস পরে পশ্চিম বাংলায় বিধান সভার নির্বাচন হয়েছিল। বিপুল ভাবে ক্ষমতায় এলো বামপন্থীরা । অ্যাকাউন্টস বিভাগে ছিলাম । একটা সর্বভারতীয় বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ না করলে পদোন্নতি হতনা । প্রচুর পড়তে হত । এতোদিন তো পরীক্ষা-টরীক্ষা দেবার কথা ভাবা যায় নি ! পরের বছর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, হলোনা । ঐসময় বাংলা অভূতপূর্ব বন্যার কবলে । অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি আর নিজেকে নিজের কথা ভাবতে দিল না।  ওখানকার চার্চএর উদ্যোগে একটা সাহায্য তহবিল তৈরী করা হয়েছিল । তখনতো আর ‘আমাদের বন্যা’ ‘ওদের বন্যা’ কিংবা ‘ম্যানমেড বন্যা’ এই রকম যুগান্তকারী আবিস্কার হয়নি ! ‘ভাঁড় মে যায় প্রমোশনের পরীক্ষা’ বলে ঝাপিয়ে পড়লাম । মনে আছে মহালয়ার দিন বোম্বে মেলএ হাওড়া থেকে ফিরছিলাম । রাত্রি আটটা নাগাদ প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল, ট্রেন তখন বাগনান স্টেশনের কাছাকাছি । কতক্ষণ ধরে বা কতদিন ধরে সেই অঝোর বৃষ্টি চলেছিল তা আর মনে নেই । ক’দিন পরেই খবরের কাগজ আর রেডিও সব জানালো । দুবছর পরে পরীক্ষা দিলাম, পাশ করলাম । রেল একটা সুযোগ পেলো বদলি করে দেবার । রায়পুরে একটা ছোট অফিসে বদলি করে দিল । দুশ’ কর্মীর অফিস থেকে সাতজন কর্মীর অফিসে রায়পুরে চলে এলাম ।


সাতাত্তরে বাংলায় বামফ্রন্টের শাসন শুরু হ’ল । নিয়ম মাফিক পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন, বামপন্থীদেরই ফিরে আসা ইত্যাদি । এরপর বলার মত কোন তরঙ্গ আমার মধ্যবিত্ত জীবনে আসেনি । যা কিছু সবই ব্যক্তিগত যোগ-বিয়োগ,তাতে কারো আগ্রহ থাকার কথা নয় ।

হ্যা, একটা বৃত্তান্ত বলা যেতে পারে । সম্ভবত ১৯৮৪ হবে । চক্রধরপুর- নাগপুর প্যাসেঞ্জারে আগুন লেগে ৫৬জন পুড়ে মারা গিয়েছিল । ওটা ৫৭জনও হতে পারতো, হয়নি । হঠাত যাওয়া, রিজার্ভেশন করে ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়া যাবেনা ভেবেছিলাম । সকালে বাজার করতে যাবার সময় রিজার্ভেশন কাউন্টারে উঁকি মারলাম । একটা বার্থ খালি ছিল, পেয়ে গেলাম । বাড়িতে বা অফিসে সকলে জানতো সেকন্ড ক্লাসেই যাচ্ছি । রাত্রি দুটো নাগাদ রাজনন্দ গাঁও স্টেশন পেরিয়ে লোকের চ্যাঁচামেচিতে ধড়মড় করে ঊঠে পড়লাম । ট্রেনে আগুন লেগেছে । কোন রকমে সঙ্গের ব্রিফকেশ টা নিয়ে লুঙ্গি পরেই জঙ্গলের মধ্যে লাফিয়ে পড়লাম । শীতের রাতে আমরা কয়েকশ’ লোক মানুষ পোড়ার গন্ধ সহ্য করে ট্রেনের তিনটে কামরা পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার সাক্ষি থাকলাম । ওই কামরাগুলোর একটাতে আমারও থাকার কথা ছিল । ভেবেছিলাম হয়তো অফিসে শোকসভার চাঁদা তোলা শুরু হয়ে গেছে । যাইহোক কয়েক ঘন্টা পরে রিলিফ ট্রেন এলো । আমি নাগপুরে পৌছে বাড়িতে বেঁচে থাকার খবরটা জানালাম ফোন করে ।

১৯৯৪এ ইচ্ছা হ’ল এবার জন্মস্থানে ফেরা যাক । একত্রিশ বছর তো ছত্তিশগড়ে কাটালাম ! কোনদিন ফেরার কথা ভাবিনি । কে এম ডি এ তে ডেপুটেশনের প্রস্তাব এলো । ওরা তখন একাউন্টস অফিসার ডিফেন্স বা রেল থেকে ডেপুটেশনে নিতো । পেয়ে গেলাম । ১৯৯৪এর ২৫শে সেপ্টেম্বর প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে ছত্তিশগড়ের পাট চুকিয়ে ফিরে এলাম । দুবছর কে এম ডি এ তে কাজ করে আবার রেলের হেড অফিসে (গার্ডেনরিচ) ফিরলাম । ২০০২এর ১লা এপ্রিল থেকে অবসর জীবন, অবসর মানে গোলামি থেকে ।

অবোধ শৈশবে বিদেশী শাসনের অবসান দেখেছি, একচ্ছত্র কংগ্রেস শাসনের অন্ত হওয়ার সাক্ষি থেখেছি, বামপন্থী শাসনের উথ্বানের তাপ-উত্তাপ গায়ে মেখেছি, আবার সেই কুখ্যাত প্রদীপ কুন্দলিয়ার বহুতল ধ্বসে পড়ার মত সেই শাসনের অন্তও দেখেছি ।

সেপ্টেম্বর চুরানব্বই থেকে কলকাতা নামক মহাসমুদ্রে । কে কার খবর রাখে ! ৯৮এর ২৩শে মার্চ অফিস থেকে ফিরছিলাম । পাড়ায় তখনকার সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে দেখলাম কয়েকজন বেশ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী টেলিভিষণে ‘জন্মভূমি’ সিরিয়াল দেখছে । সেইদিনই ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ মারা গেছেন, সংবাদ জেনেছি । চকিতে মনে পড়ে গেল চুয়াত্তরের ২৩শে জুলাই হরেকৃষ্ণ কোঙারের মৃত্যুর পর আমার এক কেরালিয়ান সহকর্মী হাউ হাউ করে কেঁদেছিল ।

পরিণত বয়সে মাঝে মাঝে নিজেকে জিজ্ঞাসা করি দেখলেতো অনেক, কি শিখলে হে ? শিখেছি বৈকি ! সেই গ্রীক রূপকথা ইউলিসিসি’এর সারাৎসার ‘যতক্ষণ তোমার পা মাটিতে ততক্ষণই তুমি প্রবল শক্তিধর’ ।

Monday, September 21, 2015

আমার কথা - ছয়



সাতাত্তরের মার্চে চাকরি ফিরে পেলাম । কয়েকমাস পরে পশ্চিম বাংলায় বিধান সভার নির্বাচন হয়েছিল। বিপুল ভাবে ক্ষমতায় এলো বামপন্থীরা । অ্যাকাউন্টস বিভাগে ছিলাম । একটা সর্বভারতীয় বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ না করলে পদোন্নতি হতনা । প্রচুর পড়তে হত । এতোদিন তো পরীক্ষা-টরীক্ষা দেবার কথা ভাবা যায় নি ! পরের বছর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, হলোনা । ঐসময় বাংলা অভূতপূর্ব বন্যার কবলে । অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি আর নিজেকে নিজের কথা ভাবতে দিল না।  ওখানকার চার্চএর উদ্যোগে একটা সাহায্য তহবিল তৈরী করা হয়েছিল । তখনতো আর ‘আমাদের বন্যা’ ‘ওদের বন্যা’ কিংবা ‘ম্যানমেড বন্যা’ এই রকম যুগান্তকারী আবিস্কার হয়নি ! ‘ভাঁড় মে যায় প্রমোশনের পরীক্ষা’ বলে ঝাপিয়ে পড়লাম । মনে আছে মহালয়ার দিন বোম্বে মেলএ হাওড়া থেকে ফিরছিলাম । রাত্রি আটটা নাগাদ প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল, ট্রেন তখন বাগনান স্টেশনের কাছাকাছি । কতক্ষণ ধরে বা কতদিন ধরে সেই অঝোর বৃষ্টি চলেছিল তা আর মনে নেই । ক’দিন পরেই খবরের কাগজ আর রেডিও সব জানালো । দুবছর পরে পরীক্ষা দিলাম, পাশ করলাম । রেল একটা সুযোগ পেলো বদলি করে দেবার । রায়পুরে একটা ছোট অফিসে বদলি করে দিল । দুশ’ কর্মীর অফিস থেকে সাতজন কর্মীর অফিসে রায়পুরে চলে এলাম ।

সাতাত্তরে বাংলায় বামফ্রন্টের শাসন শুরু হ’ল । নিয়ম মাফিক পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন, বামপন্থীদেরই ফিরে আসা ইত্যাদি । এরপর বলার মত কোন তরঙ্গ আমার মধ্যবিত্ত জীবনে আসেনি । যা কিছু সবই ব্যক্তিগত যোগ-বিয়োগ,তাতে কারো আগ্রহ থাকার কথা নয় ।

হ্যা, একটা বৃত্তান্ত বলা যেতে পারে । সম্ভবত ১৯৮৪ হবে । চক্রধরপুর- নাগপুর প্যাসেঞ্জারে আগুন লেগে ৫৬জন পুড়ে মারা গিয়েছিল । ওটা ৫৭জনও হতে পারতো, হয়নি । হঠাত যাওয়া, রিজার্ভেশন করে ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়া যাবেনা ভেবেছিলাম । সকালে বাজার করতে যাবার সময় রিজার্ভেশন কাউন্টারে উঁকি মারলাম । একটা বার্থ খালি ছিল, পেয়ে গেলাম । বাড়িতে বা অফিসে সকলে জানতো সেকন্ড ক্লাসেই যাচ্ছি । রাত্রি দুটো নাগাদ রাজনন্দ গাঁও স্টেশন পেরিয়ে লোকের চ্যাঁচামেচিতে ধড়মড় করে ঊঠে পড়লাম । ট্রেনে আগুন লেগেছে । কোন রকমে সঙ্গের ব্রিফকেশ টা নিয়ে লুঙ্গি পরেই জঙ্গলের মধ্যে লাফিয়ে পড়লাম । শীতের রাতে আমরা কয়েকশ’ লোক মানুষ পোড়ার গন্ধ সহ্য করে ট্রেনের তিনটে কামরা পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার সাক্ষি থাকলাম । ওই কামরাগুলোর একটাতে আমারও থাকার কথা ছিল । ভেবেছিলাম হয়তো অফিসে শোকসভার চাঁদা তোলা শুরু হয়ে গেছে । যাইহোক কয়েক ঘন্টা পরে রিলিফ ট্রেন এলো । আমি নাগপুরে পৌছে বাড়িতে বেঁচে থাকার খবরটা জানালাম ফোন করে ।

১৯৯৪এ ইচ্ছা হ’ল এবার জন্মস্থানে ফেরা যাক । একত্রিশ বছর তো ছত্তিশগড়ে কাটালাম ! কোনদিন ফেরার কথা ভাবিনি । কে এম ডি এ তে ডেপুটেশনের প্রস্তাব এলো । ওরা তখন একাউন্টস অফিসার ডিফেন্স বা রেল থেকে ডেপুটেশনে নিতো । পেয়ে গেলাম । ১৯৯৪এর ২৫শে সেপ্টেম্বর প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে ছত্তিশগড়ের পাট চুকিয়ে ফিরে এলাম । দুবছর কে এম ডি এ তে কাজ করে আবার রেলের হেড অফিসে (গার্ডেনরিচ) ফিরলাম । ২০০২এর ১লা এপ্রিল থেকে অবসর জীবন, অবসর মানে গোলামি থেকে ।

অবোধ শৈশবে বিদেশী শাসনের অবসান দেখেছি, একচ্ছত্র কংগ্রেস শাসনের অন্ত হওয়ার সাক্ষি থেখেছি, বামপন্থী শাসনের উথ্বানের তাপ-উত্তাপ গায়ে মেখেছি, আবার সেই কুখ্যাত প্রদীপ কুন্দলিয়ার বহুতল ধ্বসে পড়ার মত সেই শাসনের অন্তও দেখেছি ।

সেপ্টেম্বর চুরানব্বই থেকে কলকাতা নামক মহাসমুদ্রে । কে কার খবর রাখে ! ৯৮এর ২৩শে মার্চ অফিস থেকে ফিরছিলাম । পাড়ায় তখনকার সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে দেখলাম কয়েকজন বেশ নিবেদিতপ্রাণ কর্মী টেলিভিষণে ‘জন্মভূমি’ সিরিয়াল দেখছে । সেইদিনই ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ মারা গেছেন, সংবাদ জেনেছি । চকিতে মনে পড়ে গেল চুয়াত্তরের ২৩শে জুলাই হরেকৃষ্ণ কোঙারের মৃত্যুর পর আমার এক কেরালিয়ান সহকর্মী হাউ হাউ করে কেঁদেছিল ।

পরিণত বয়সে মাঝে মাঝে নিজেকে জিজ্ঞাসা করি দেখলেতো অনেক, কি শিখলে হে ? শিখেছি বৈকি ! সেই গ্রীক রূপকথা ইউলিসিসি’এর সারাৎসার ‘যতক্ষণ তোমার পা মাটিতে ততক্ষণই তুমি প্রবল শক্তিধর’ ।


আমার কথা - পাঁচ



১৯৭৫ থেকে জানুয়ারি সাতাত্তর আমার কাছে ছিল স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে অনুজ্বল, সবচেয়ে মসিকৃষ্ণ সময়কাল । ১২ইজুন ১৯৭৫, এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল নির্বাচনে অসাধু উপায় গ্রহণের জন্য ইন্দিরা গান্ধির নির্বাচন বাতিল,তাঁর সাংসদ পদ ও বাতিল । তিনি সুপ্রিম কোর্টে গেলেন আর এই অবসরে সময়ে নির্বাচন এড়িয়ে সংসদের মেয়াদ দুবছর বাড়িয়ে দিলেন । দেশে প্রবল প্রতিবাদের ঢেউ । ২৫শে জুন জারি করলেন আভ্যন্তরীন জরুরী অবস্থা । সমস্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হলো, বিরোধী সব রাজনৈতিক নেতাদের কারান্তরালে পাঠালেন ভারত রক্ষা আইন, আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা আইন বা সংক্ষেপে ‘মিসা’য়, বিনা পরোয়ানায়, বিনা বিচারে বিরোধীদের কারান্তরালে পাঠানোর অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হলো পুলিশকে । মত প্রকাশের অধিকার, সংবাদ প্রকাশের অধিকার, বিচার প্রার্থনার মৌলিক অধিকার লোপ করা হলো, সংবাদ পত্র সহ পত্র-পত্রিকায় সেন্সর বিধি লাগু করা হলো । পাড়ায় পাড়ায় ইতিহাসে পড়া গেস্টাপো বাহিনীর মত হামলা অন্য মত’এর প্রতি । নাটকের মঞ্চে হামলা, নাট্যকর্মী খুন – সে এক বৃহন্নলা সময় – আমাদের কন্ঠনালী তাক করা বন্দুকের নল । রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ করতেও লালবাজারে উর্দিপরা লোকেদের অনুমোদন নিতে হ’ত ।

দিনটা ছিল ২৭শে জুন ১৯৭৫ । কারো মুখ থেকে শুনলাম আগের দিন গভীর রাতে নাকি ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে । আমল দিইনি, হয়েছে তো হয়েছে, ১৯৬২তে চিন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময়ওতো ইমার্জেন্সি জারি করা হয়েছিল শুনেছি । ভেবেছিলাম সেইরকমই কিছু হবে । চাকরী না থাকলেও প্রতি দিনের মত সেদিনও অফিসের ক্যানটিনে আমাদের চাকরীহীন কয়েকজনের চাএর আড্ডা চলছিল । আর্থার হাইড নামে একজন নামি হকি কেলোয়াড় ছিল । গুন্ডামি করতো, জুয়ার তোলাবাজি করতো, কিন্তু আমাদের খুব ভালোবাসতো । হাইডকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল । ওখান থেকেই ওর কোন চেলাকে দিয়ে আমাদের খবর পাঠিয়েছিল ‘ভাগো, ‘মিসা’ যা রহা হায়’ ইতিমধ্যে খবরের কাগজে আগের দিন রাত্রে লোকসভার প্রায় সব বিরোধী নেতাদের গ্রেফতারের খবর জেনেছি । ‘মিসা’ বা ‘মেইনটেন্যান্স অফ ইনটারনাল সিকিউরিটি এক্ট’এর মহিমার কথাও জেনে গিয়েছিলাম । আমরা তিনজন ছিলাম ‘হিট লিষ্ট’। যে যার ছিটকে গেলাম ।

নিজের কোয়ার্টারেতো থাকা যাবে না, এক সহকর্মীর কোয়ার্টারে একটা ঘরে বাইরে থেকে তালাবন্ধ অবস্থায় থাকলাম দুটোদিন । কলোনির শুকনো রাস্তায় ধুলো ওড়ানো পুলিশ জীপের হন্যেদৌড় । আমার কোয়ার্টারে পুলিশ পরোয়ানা সেঁটে দিয়েছিল আর অফিসে জানিয়ে দিয়েছিল ‘সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হ’ল’ বলে । তখন আমার সম্পত্তি বলতে ছিল তো প্রভিডেন্ড ফান্ডে পড়ে থাকা শ’ আড়াই টাকা ! পরে সেই পরোয়ানার কপি আদালত থেকে তুলেছিলাম, লেখাছিল ‘দেশ বিরোধী নাটক করি, আর রেলওয়ে মার্কেটটা নাকি জ্বালিয়ে দেবার ছক কষেছিলাম’ । বোঝ কান্ড ! সেই পরোয়ানার কপিটা এখনো আমার কাছে আছে ।

বন্ধুরা বাইরে বিকল্প রাস্তা খুজছিলেন আমাদের পালানোর ব্যবস্থা করার । পরদিন দুপুরে লুঙ্গি পরে মাথায় একটা গামছা জড়িয়ে গ্রামীণ রাস্তা ধরে টাঙ্গা করে একটু দূরের একটা স্টেশন থেকে একটা মালগাড়িতে গার্ডের সঙ্গে টাটানগর পৌছালাম । সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে কলকাতা । কলকাতাতো এলাম থাকবো কোথায় ? নিজের বাড়ি যাওয়া চলবে না । বন্ধুরা খিদিরপুরের একটা মেস’এ একবন্ধুর অতিথি হয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করল । খাওয়া, বাবু বাজারের একটা হোটেলে । খিদিরপুরের মেস’এ নানা সন্দেহের চোখ, কোথায় থাকতাম, এখানে থাকছি কেন এই সব । তিনদিন পরে অন্য ব্যবস্থা হল বেহালায় ইস্টার্ণ রেলের চাকরি যাওয়া এক সহকর্মীর নির্মীয়মান বাড়ির একটা ঘরে শোয়া আর অন্য এক (এখন প্রয়াত) বন্ধুর বাড়িতে খাওয়া । সে তখন চাকরি হারিয়ে ফুটপাথে জামা কাপড় বিক্রি করতো । ফাঁকা বাড়িতে একাএকা থাকা নিরাপদ ছিল না । পরের দিন থেকে বন্ধুর বাড়িতেই থাকারও ব্যবস্থা হ’ল । রোজ বিকালে কার্জন পার্কে এসে মিলতাম । রোজই কেউনা কেউ বিলাসপুর থেকে আসত । দেখা হ’ত, খবরের আদান-প্রদান হ’ত । দিনপনেরো এইভাবে চললো । জানতে পারলাম মধ্য প্রদেশের ‘মিসা’ কলকাতায় প্রযোজ্য নয় । আড়িয়াদহে বাড়ি ফিরে গেলাম । এই সময় মফঃস্বলের নাটকের দলগুলোর সঙ্গে খুব যোগাযোগ রাখতাম । নাট্যকার অমল রায় ছিল আমার ছোট ভাইএর বন্ধু, ওর ঘরেই আড্ডা জমাতাম । নানান যায়গায় একাঙ্ক প্রতিযোগিতার ও নাট্যোসবের নাটক দেখে বেড়াতাম । কলকাতার ‘অভিনয়’ পত্রিকার দপ্তরেও আড্ডা জমাতাম, নাটকের খবর, ছোটখাটো লেখা ইত্যাদি দিতাম । ব্যারাকপুরের একটা নাটকের গোষ্ঠী একটা মান্থলি টিকিট কেটে দিয়েছিল, আমি রোজ সন্ধ্যায় রিহার্শাল দিতে যেতাম, কয়েকটা অভিনয় করেছিলাম তাদের সঙ্গে । চাকরি নেই সুতরাং অখন্ড সময় । লাইব্রেরীর রিডিংরুমে বসে সুযোগ পেলাম প্রচুর বই পড়ার । কয়েকটা রজনী যাত্রাভিনয়ও করেছি । বেকার নাট্যশিল্পীদের যদি কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করা যায় এই লক্ষ্যেই ‘মুকুন্দরাম যাত্রা সমাজ’ নামে একটা  অপেশাদার যাত্রার দল বানিয়েছিলাম নাট্যকার অমল রায়ের উদ্যোগে । সে শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটিকে যাত্রা রূপ দিয়েছিল । সুবিখ্যাত পালাকার ব্রজেন দের ইছাপুরের বাড়িতে যাত্রা উৎসব হ’ত । আমরা সুযোগ পেলাম । দারুণ অভিজ্ঞতা হলো । তারপর দক্ষিণেশ্বর, চন্দন নগর ও গরিফায় অভিনয় করেছিলাম । গরিফায় অভিনয় চলার সময় সেকালের নয়া ‘গেস্টাপো’ বাহিনীর হামলার মুখে পড়েছিলাম । অভিনয় শেষ করতে দেয় নি । ওখানকার নাট্যকর্মীরা কোনরকমে আমাদের নৈহাটি লোকালে তুলে দিয়েছিলেন ।

সময় এগিয়ে চলে । কর্মক্ষেত্রে বন্ধুদের সাহায্য তহবিল থেকে আসা অর্থের পরিমানও কমতে থাকে । অর্থকরী কিছু করার জন্য চেষ্টা করি । একটা একশ’’টাকা মাইনের টিউশানি জোগাড় করলাম, আর চা বিক্রি করতে লাগলাম । কলেজ স্ট্রীটের সুবোধ ব্রাদার্স আর বি কে সাহার দোকান থেকে পাইকারি দরে চা কিনে, ঘরেতে ব্লেন্ড আর প্যাকেট করে ব্যাগ বোঝাই চা গার্ডেনরিচ’এ রেলের অফিসে নিয়ে যেতাম  । কিন্তু জমল না তেমন । কিছু লোক পরের মাসে টাকা দেবেন, কিন্তু ভাবখানা এমন ছিল যেন কি বিরাট সাহায্য করছেন কোন অভাবী লোককে, অনুকম্পার দৃষ্টি ! ছেড়ে দিলাম । কিছু দিন প্রেসের কাজ করলাম, নাট্যগোষ্ঠীর লেটার প্যাড, ছোট কোম্পানির বিল ইত্যাদির অর্ডার নিয়ে হ্যারিশন রোড থেকে কাগজ কিনে শিয়ালদহর প্রেস থেকে ছাপিয়ে নিতাম । খুব একটা লাভের মুখ অবশ্য দেখিনি । ছেড়ে দিলাম । শেষে একজন মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভএর চেষ্টায় শোভাবাজারে ছোট একটা বাঙালি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানীর অফিসে পার্টটাইম চাকরী – মাইনে মাসে একশ’ টাকা । এই কাজটা করতে করতেই চলে এল সাতাত্তর ।

১৯৭৭এর ২১শে মার্চ জরুরী অবস্থা প্রত্যাহৃত হ’ল । ১৬ থেকে ২০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের হ’ল । কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেসের একদলীয় শাসনের অবসান হ’ল । মোরারজি দেশাইএর নেতৃত্বে জনতা পার্টির সরকার গঠিত হ’ল ২৪শে মার্চ । রেলমন্ত্রী হলেন মধু দন্ডবতে । রেলমন্ত্রী হয়ে প্রথম যে সরকারী কাগজে সই করেছিলেন তিনি, সেটি ছিল ভারতের সমস্ত বরখাস্ত ধর্মঘটী রেলকর্মীদের চাকুরিতে পুণর্বহালের এর আদেশনামা ।

মাথা উঁচু করে কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলাম । কাজে যোগ দিলাম । ‘ভারত রক্ষা আইন’ ‘মিসা’ এইসব কালা কানুনের কোন অস্তিত্ব থাকলো না । সুতরাং বরখাস্ত হয়ে থাকা সময়ের পুরো বেতন ফেরত পেলাম । কর্মী সংগঠনের সাহায্য তহবিল থেকে পাওয়া টাকা তাদের ফেরত দিয়ে দিলাম ।

‘পুরানো সেই দিনের কথা’র নটেগাছ মুড়িয়ে এনেছি প্রায় । পরের পর্ব মানে শেষ পর্বে সামান্য কথা । চুরানব্বইএ ছত্তিশগড় থেকে বাংলায় ফিরে আসা এই সব.


আমার কথা - চার



১৯৬৯ । শোনা গেলো বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ । তরাইএর কৃষক আন্দোলন আর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়লো সারা বাংলায় । দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টও ভেঙ্গে গিয়ে শুরু হ’ল রাষ্ট্রপতি শাশন । কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্বল তরুণরা  ঝাঁপপিয়ে পড়লো সেই অগ্নি সময়ের অচেনা আহ্বানেপ্রবল শক্তিধর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে । ঘরে ১৮বছর বয়সী সন্তান থাকলে মা-বাবার দুশ্চিতার অন্ত থাকতো না । তাদের বাড়ির বাইরে গেলে ঘরে ফেরা নিশ্চিত ছিল না । গুপ্তহত্যা, জেলখানায় হত্যা,  কলকাতার গলিতে ছড়িয়ে থাকা তরুণের মৃতদেহ ডিঙ্গিয়ে মানুষ অফিস-কাছারি করছেন, বরানগর কাশিপুরে লরিভর্তি মৃতদেহ পাচার হয়েছিল । সামনে একাত্তরের ভোট ছিল । সেসব কথা না ছোঁয়া দূরত্বে থাকলেও তার গনগনে আঁচ  সাতাশ বছরের আমাকে রেহাই দেবে কেন ? কাকেই বা দিয়েছিল ?

বছরে দুতিনবার বাড়ি যেতাম । চুটিয়ে নাটক দেখতাম ছোট দলগুলির নাটক । প্রতিষ্ঠান বিরোধী, বেশ রক্ত গরম করা নাটক । কার্জন পার্কে কত আনামি গোষ্ঠী মঞ্চ ছাড়াই ছোট ছোট নাটক করতো,কলকাতায় এলে দেখতাম । বোধয় একাত্তরের জুলাই মাস হবে, প্রবীর দত্ত নামে কার্জন পার্কে নাটক দেখতে আসা এক তরুণ পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল । সেই সময় আমরা বিলাসপুরে একটা সর্বভারতীয় বাংলা একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম বাংলার জেলা শহরের নাট্যগোষ্ঠীগুলি আসতো । এখানকার নাট্য আন্দোলনের ঢেউ আমাদের ওখানেও আছড়ে পড়ে । আমিও তরুণদের নিয়ে নাটকের দল করে নাগপুর, জব্বলপুর,জামশেদপুর, আদ্রা, ভিলাই এরকম কতযায়গায় গিয়েছি । ১৯৭২এর কোন মাস মনে নেই ১৭/১৮ বছর বয়সী  থিয়েটারে আনকোরা এক তরুণকে একটা নাটকে অভিনয় করাই ।  তারপর ছেলেটিকে আর খুঁজে পাই নি । এই কদিন আগে ঢাকা থেকে আমাকে খুজে পেলো ফেসবুকে । চল্লিশ বছর পরে প্রবল উচ্ছাসে মেসেজ করে জানালো দাদা আপনার কাছ থেকে সতেরোটা টাকা নিয়েছিলাম, ফেরত দেওয়া হয়নি মনে আছে । কি বিস্ময়কর খুঁজে পাওয়া প্রিয় মানুষকে ! সময় অনেক কিছু কেড়ে নেয় বটে, আবার ফিরিয়েও দেয় কিছু না কিছু ! কলকাতার ‘অভিনয়’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় দূরের মঞ্চে বাংলা নাটকের খবর লিখতাম নিয়মিত । ‘রঙ্গমঞ্চ’ নামে একটা ছোট নাট্য পত্রিকায় সংযুক্ত সম্পাদক হয়ে যুক্তও ছিলাম ১৯৭৫ পর্যন্ত ।

চুয়াত্তরের গোড়ায় রেলকর্মীদের ‘স্ট্রাইক ব্যালট’ আহ্বান করলো রেলের ইউনিয়ন । সারা ভারতে নব্বই ভাগেরও বেশি রেলশ্রমিক লাগাতার ধর্মঘটের পক্ষে মত দিল । প্রধান দাবী ছিল ‘ওয়েজ প্যারিটি’ বা সমান কাজে সমান বেতন ও সকলের জন্য বোনাস । ৮ইমে ১৯৭৪ থেকে সারা ভারতে লাগাতার রেল ধর্মঘটের ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হলো । বিভিন্ন রেল শ্রমিক সংগঠনগুলিকে একটা কেন্দ্রীয় কমিটির আওতায় নিয়ে এসে তৈরী হয়েছিল ‘ন্যাশানাল কোওর্ডিনেশন কমিটি ফর রেলওয়ে মেনস স্ট্রাগল’ বা এন সি সি আর এস । সম্ভাব্য দমন পীড়ন মোকাবিলার জন্য অর্থ সংগ্রহ, রেলকলোনিগুলোতে কর্মীদের, তাদের বাড়ির মহিলাদের মিছিল ইত্যাদি হতো । সে এক অগ্নিগর্ভ দিন । একত্রিশ বছরের আগুণখেকো আমার চাকরীর বয়স তখন সবে নয় বছর । সবাই ধর্মঘটে সামিল হবেন না জানতাম কিন্তু তাদের নৈতিক সর্থন ছিল রেলকর্মীদের পরম ভরসার যায়গা ।

ধর্মঘট শুরুর দিন এগিয়ে এলো । ধর্মঘট বে-আইনী ঘোষণা করলো সরকার । পয়লা মে ‘মে দিবসে’র মিছিল ছিল শহরেআমি যাইনি । জানতে পারলাম প্রথম সারির রেলকর্মীদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ । বাংলা নাটক আর কবিতা চর্চা করা আমার মত বাউন্ডুলে ছেলে ছত্তিশগড় পুলিশের ‘হিট লিস্ট’এ ঢূকে গিয়েছিলাম কিকরে, বুঝতে পারি নি । ৫ই মে বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে অফিস যাচ্ছিলাম । ডিআরএম অফিসের সামনে থেকে আমাকেও গ্রেপ্তার করলো পুলিশ । জেলখানার লাপসি খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেলো । আমাদের সঙ্গে একই সেল’এ ছিলেন এখনকার বেশ বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা শরদ যাদব । ও তখন জব্বলপুরের ফায়ারব্রান্ড ছাত্রনেতা, স্যোশালিস্ট পার্টির । শরদকে আর রেলকর্মী বন্ধুদের রোজই শোনাতাম নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠি কবিতাটা, “মানুষের মুন্ডুটাতো বোঁটার ফুল নয় যে ইচ্ছা করলেই ছিঁড়ে নেবে” ! জেলে থাকতেই শুনেছিলাম ভারত নাকি রাজস্থানের ‘পোখরান’এ তার প্রথম আনবিক পরীক্ষা করেছে । উনিশ দিন চলেছিল রেল ধর্মঘট । উনিশ দিনের মাথায় ভেঙ্গে গিয়েছিল । দেশের নানা প্রান্তে অভূতপূর্ব দমন-পীড়ন নেমে এসেছিল ধর্মঘটী রেল শ্রমিক আর তাদের পরিবারের ওপর । এখনকার প্রজন্মের মানুষদের শিঊরে ওঠার মত উপাদান ছিল সেই পীড়নেজানিনা তারা কতটুকুই বা জানেন রাষ্ট্রের সেই বে-নজির প্রতিহিংশার কথা । রেলের কারখানাগুলিতে ধর্মঘটের প্রভাব ছিল বেশি । দেশের অনেক যায়গায় রেলকলোনির ধর্মঘটী পরিবারের কোয়ার্টারে বিদ্যুৎ আর জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল, তাদের সন্তানদের রেলের স্কুলে ভর্তি নেয়নি ।

২৭শে মে ধর্মঘট ভেঙ্গে গেলো । আমরা জেল থেকে ছাড়া পেলাম আরো দিন তিনেক পরে । চাকরিতে জয়েন করতে দিল না । জানলাম বে-আইনী ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার জন্য চাকরি ‘ঘ্যাচাং’ হয়ে গেছে । সারা ভারতে হাজার হাজার রেল কর্মচারির চাকরি চলে গিয়েছিল রাষ্ট্রের সে এক অভূতপূর্ব প্রতিহিংশামূলক পীড়ন তার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে । তবুও নতজানু হয়নি তারা । অফিসে আমার শুভাকাঙ্খী দাদারা যারা ধর্মঘট থেকে বিরত ছিল, তখনকার বেশ কেউকেটা মন্ত্রী সম্প্রতি প্রয়াত বিদ্যাচরণ শুক্লার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল । ওর কাছে গিয়ে বলতে হবে, কম বয়স, ভুল করে ফেলেছি, আর বেয়াদব হবো না, এইরকম ।

দেশের প্রথম সারির আইনবিদরা রেলকর্মীদের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছিলেন । আমার মামলাটা কলকাতা হাইকোর্টে লড়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় । মনে আছে, অমিয় কুমার মুখার্জীর ঘরে দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে বরখাস্ত করার রেলের হুকুমনামা খারিজ হয়ে যায় । ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন না নিয়ে কারো চাকরি খেয়ে নেওয়া যায় না । সেই প্রথম আমার হাইকোর্ট দেখা । মামলা খারিজ হলেও চাকরি ফেরত পাইনি তখন অবাস্তব সব অভিযোগ এনে ‘মেজর পেনালটি চার্জশীট’ ধরিয়ে দেয় অর্থাৎ যেভাবেই হোক দোষী সাবস্ত করে চাকরী খাওয়ার বন্দোবস্ত । তবে হ্যাঁ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছিলাম । সেই শুনানি আর শেষ করতে পারে নি রেল । ‘নির্যাতিত রেলকর্মী তহবিল’ থেকে অর্থ সাহায্য পেতাম, চলে যেত বা চালিয়ে নিতে হতো । কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে বাড়ি যেতে পারতাম না, অনেক দিন রেলের পাস’এর তোয়াক্কা না করেই কলকাতা চলে যেতাম । রেলের মুখচেনা টিটি, তারা নিয়ে যেতো । কোনদিন আবার প্যান্ট্রি কারের ম্যানেজারের কোচে মুরগির ঝোল ভাত খেয়ে তাদের সঙ্গেই চলে আসতাম ।

বছর শেষ হ’ল । এলো স্বাধীন ভারতের চবচেয়ে মসিকৃষ্ণ কালখন্ড জারি হয়েছিল জরুরী অবস্থা । ‘মিসা’ কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে  বেপাত্তা হয়ে গেলাম রেল কলোনি থেকে । সাতাত্তরে চাকরি ফিরে পেলাম । বলবো পরের পর্বে ।


আমার কথা - তিন



একটা তেরো টাকা দামের রেক্সিনের স্যুটকেশ, পকেটে তিরিশটা টাকা আর একটা সতরঞ্চি সঙ্গি করে হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিয়েছিলাম । রেল একটা পাশ পাঠিয়ে দিয়েছিল এপয়েন্টমেন্ট লেটারের সঙ্গে । দুজন খুব কাছের বন্ধু হাওড়া স্টেশনে এসেছিল তুলে দিতে তাদের একজনের বাবার ট্যাক্সি ভাড়া খাটতো । সেদিন রাস্তায় বেরোয় নি, আমাকে নিয়ে এলো তাদের গাড়ি করে । আর একজন দুপ্যাকেট পানামা সিগারেট কিনে দিল । রাত্রি আড়াইটা নাগাদ বোম্বাই এক্সপ্রেস বিলাসপুর পৌছালো । প্ল্যাটফর্মে সতরঞ্চিটা বিছানোর একটা যায়গা পেয়ে গেলাম। দেখলাম আরো দুএকটা সতরঞ্চি বিছানো হচ্ছে । ব্যস ওখান থেকেই নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ শুরু হ’ল । একই পথের পথিক তোআর একা থাকলাম না। তিনজনে মিলে ‘আমরা’ হয়ে গেলাম ।

রেলের বাজারে একটা বাঙালি হোটেলে ৬০ পয়সায় মাছভাত খেয়ে অফিসে রিপোর্ট করলাম । পুরানো লোকেরা অনেক ভালোবাসা দিলেন । বড় ডিভিসনাল অফিস, অনেক লোক কাজ করেন সত্তর ভাগ বাঙালি আর তিরিশ ভাগ দক্ষিণ ভারতীয়, সবাই কলকাতা বা খড়গপুর থেকে বদলি হয়ে গেছেন ওখানে । বাঙ্গালিদের দল ভারি হল – আদরতো পাবোই । মেডিক্যাল হতে দিন তিনেক লাগলোপ্রথমে সপ্তাখানেক শোয়ার ব্যবস্থা হ’ল যাযাবরের মতো – মানে কেউ ছুটিতে গেছেন তার কোয়ার্টারে শুয়ে ঘর পাহারা দেওয়া । পরে একটা মেসে ঢুকে গেলাম । একটা রেল কোয়ার্টারে আরো ৪/৫ জনের সঙ্গে ভাগ করে থাকা, দশটাকাকা দিয়ে কেনা একটা দিড়ির চারপাইএ শোয়া, আর অন্য একটা মেস’এ খাওয়া কুড়ি জনের মত একসঙ্গে । ২৩ বছর বয়স – ছাড়া গরুর মতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা বলার মত কেউ নেই, ওটা কোরনা বলার মত কেঊ নেই, শুধু নিজের জন্য কিছু ভাবার মত মনটাও তৈরী হয় নি ।

নাটকের দল করা, রেলকলোনির রিক্রিয়েশন ক্লাব লাইব্রেরী, সাংস্কৃতিক সামাজিক কাজকর্ম, মৃতদেহ সৎকার, হাসপাতালে রাত জাগা , কাজের বাড়িতে পরিবেশন করা এইসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আর  এইসব করার সুবাদে প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলাম । মায়ের মত, নিজের বড় দাদার মত ভালোবাসা মানুষের ওষ্ঠ থেকে তার বিষদ-বিন্দু শুষে নিতে চাওয়ার মধ্যে, আর একজনের চকচকে চোখ দেখতে পাওয়ার মধ্যে যে কি আনন্দ, কি সুখ তার তো কোন লিখিত শব্দ হয় না ! মা ভাই বোন ছেড়ে দূরে থাকার কোন কষ্টই সেইসব মানুষেরা আমাকে পেতে দেননি । থিয়েটার আর কবিতার আবৃত্তি খুব করতাম সামান্য যা লেখালেখির চর্চা করতাম তা গদ্য । কবিতা লেখার চেষ্টা করিনি কোন দিন, ইচ্ছেও হতো না হাংরি জেনারেশন না কিসব বলতো নিজেদের, ওদের কবিতা কয়েকটা পড়ে আধুনিক কবিতার ওপরই একটা বিতৃষ্ণা এসেছিল, ওগুলোকে ‘অন্ধকারের জীবন বেদ’ মনে হতো ।

১৯৬৭ তে সারা ভারতে প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া জাতীয় কংগ্রেসের সারা ভারতে একচ্ছত্র শাসনের টালমাটাল অবস্থা, পশ্চিম বাংলাতেও প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার করলো অজয় মুখার্জীর মুখ্যমন্ত্রীত্বে, বছর না পেরোতেই রাষ্ট্রপতি শাসন জাতীয় কংগ্রেসের একচ্ছত্র শাসন অবসানের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ থেকেই । সেই উত্তাপে শরীর সেঁকেছিলাম আমরা অনেকেই, দূরে থেকেও

১৯৬৮র ১৯শে সেপ্টেম্বর রেল সহ কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারিদের সংগঠনগুলি একদিনের টোকেন স্ট্রাইক ডাকলো । স্ট্রাইক বে-আইনী ঘোষণা করলো সরকার । তো কর্মচারীদের স্ট্রাইক আবার কবে আইনী হয় ! আমার চাকরির বয়স তখন সবেমাত্র তিন বছর সাত মাস দাবি ছিল প্রয়োজন ভিত্তিক ন্যুনতম বেতন । ‘চল পানসি বেলঘরিয়া’, ‘যো হোগা দেখা যায়গা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ধর্মঘটে । ‘ব্রেক ইন সার্ভিস’ হ’ল , মানে আমার চাকরি জীবনের একটা দিন মাইনে সহ বাদ হয়ে গেলো । সেই একটা দিন এবং একদিনের বেতন আর ফিরে পেলাম না । বার্ষিক মাইনে বাড়ার বা ইনক্রিমেন্ট’এর দিনটাও পিছিয়ে গেলো একদিন । সার্ভিস বুকে প্রথম লালকালির দাগ পড়লো , তা পড়ুক । চাকরির তিন বছরের মাথায় এই শাস্তি যে আমাকে দমিয়ে দিয়েছিল তা নয় বরং আরো কঠিন করেছিল মানসিক ভাবে ।


খবরের কাগজে আজ দেখলাম । ১৯৭৪এর পর ভারতীয় রেলের ১৩লক্ষ কর্মচারী লাগাতার ধর্মঘটের নামতে চলেছেন । নব্বইভাগ রেলকর্মচারীই ধর্মঘটের পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন । ১৯৭৪এর সেই সময় এবং ঠিক একবছর পরে সেই কৃষ্ণপ্রহর ১৯৭৫এর জরুরী অবস্থাকে ছুঁয়ে যাবো পরের পর্বে ।

আমার কথা - দুই



স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল, মনে আছে, ৪ঠা আগস্ট । পাশ তো করলাম,কিন্তু বই কেনা কলেজের মাইনে, ট্রেনের মাসিক টিকিট এসবের টাকা পাবো কোথায় ?  একটা টিউসানি পেয়ে গেলাম । ক্লাস সিক্সএর ছেলে। সেই ছিল আমার প্রথম টিউসানি, সেই প্রথম একদম নিজের আয় হাতে পাওয়া । দশটাকা মাসে । সঙ্গে ক্লাস টুএর একজন ফাউ । প্রি-ইউনিভার্সিটি পড়তে পড়তে একটা লাইব্রেরীতে লাইব্রেরিয়ানের কাজ পেলাম । মামুলি লাইব্রেরী নয় । আড়িয়াদহ এসোসিয়েশন লাইব্রেরী এখন ১৪৪ বছর বয়স । মাসে কুড়ি টাকার সান্মানিক, তখন তাইই অনেক । লাইব্রেরিয়ানের কাজটা যে আমাকে কি আনন্দ দিল ! বইএর জগতে না ঢুকলে তো বোঝা যায় না । সাহিত্য আর ইতিহাস পড়ার নেশাটা যেন রক্তের মধ্যে মিশে গেলো ।

বেশ কয়েকটা টিউসানি পেয়ে গেলাম । উজ্বল সব তরুণ । সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময়, অনেকেরই মনে আছে বারাসাতের রাস্তায় আটজন তরুণের বস্তাবন্দি লাশ ছড়িয়ে দিয়েছিল কারা যেন । তার মধ্যে একজন ছিল আমার ছাত্র । তখন আমি ছত্তিশগড়ে চাকরি করি । সেই উত্তাল সময়টা নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু সেই সময়ের আঁচ থেকে বাঁচতে পারিনি, কেইই বা পেরেছিল ! তখন বাংলায় ‘সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি’, নুনের চেয়েও খুন সস্তা । নিজ সন্তানের ছিন্নশির সোনার থালায় সাজিয়ে কাকে ভেট দিয়েছিলাম আমরা ? ১৯৭১এর ২৫শে জুলাই হাজারিবাগ সেন্ট্রাল  জেলে ১৬জন নকশাল বন্দি তরুণের হত্যা হয়েছিল । সেই ষোল জনের একজন ছিল আমার সহোদর ছোটভাই । সংবাদপত্রে দেখেছিলাম পুলিশের গুলিতে মারা গেছে । অন্য বন্দিদের লেখা নানান পত্রিকায় পড়ে জেনেছিলাম জেলের মধ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল । মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়নি,হাতে পায়ে বেড়িপরা জেলের অন্ধকারে লেখা তার কবিতা-গল্প লেখার খাতাটাও ফেরত দেয়নি । এমনকি পরের দিন আমার হাজারিবাগ যাওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করেনি । শুধু একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল । একবার চাইবাসা জেলএ দেখতে গিয়েছিলাম , পকেটের চারমিনারের প্যাকেটটাও খুলে দেখেছিল কারারক্ষী । তখনতো মানবাধিকার ইত্যাদি শব্দগুলো হিব্রুভাষার অচেনা শব্দ ছিল !

এইটুকুই থাক। হৃদয় খোঁড়া বেদনা আমারই থাক, শুধু আমারই । আমি শুধু আমার গায়ে এখনও লেগে থাকা সময় বা দুঃসময়টাকে ছুঁয়ে গেলাম । আজকের ‘গোলাপ দিবস’ আমার কাছে নাহয় এরকমই হোক !

চৌষট্টির ডিসেম্বর থেকে জন্মস্থান ছেড়ে দূরে চলে যাই চাকরি নিয়ে । বছরে এক দুবার কয়েকদিনের জন্য আসতাম । স্থায়ী ভাবে আর ফিরে আসিনি । ১৯৭৫এর পর থেকে আমাদের নিজস্ব কোন ছাদ ছিলনা যে !

আমার কথা - এক



জন্মেছিলাম ১৯৪২এর মার্চ’এ । মানে স্বাধীনতার দিন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন । স্বাধীনতার দিনটার কথা মনে নেই , কিন্তু পরের বছর গান্ধীজির মৃত্যুদিনের কথা একটু একটু মনে আছে ।  আর মনে আছে – কি করে মনে আছে কে জানে, যুদ্ধজনিত কারণে দোকানে চাল ডাল অমিলের কথা । বাবার কোলে চেপে রেশনের দোকানে অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়ানোর কথাও খুব হালকা করে মনে পড়ে । খুব প্লেনের আওয়াজ শুনে ভয় পেতাম, মনে হতো এরোপ্লেনগুলো খুব নীচু দিয়ে যাচ্ছে । যুদ্ধ থেমে গেলেও এরোপ্লেনের আনাগোনা , সেনাদের প্যারেড এইসব ছিলই । প্লেন অবশ্য খুব কাছ থেকেই দেখেছি । আমাদের আড়িয়াদহের বাসা থেকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার পথে একটা মিলিটারি আস্তানা এখনো আছে । ওটা আগে ছিল ব্রিটিশ সেনাদের ক্যাম্প । এরোপ্লেনের রানওয়েটা এখনো আছে । তখন ইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি, অনেক কিছু দেখছি, বুঝতে শুরু করেছি । দেশ ভাগ, দাঙ্গা, এইসব উত্তেজনা তখন আমার গায়ে লাগার কথা নয়, কিন্তু মনে আছে পাড়ার দাদারা বলাবলি করতো কামারহাটি থেকে একদল মুসলমান নাকি আসবে । দাদারা লাঠি-সোটা নিয়ে পাড়া পাহারা দিতো । আমরা ঘরের মধ্যে সিটিয়ে থাকতাম  দরজা জানালা বন্ধ করে । সাতচল্লিশ-আটচল্লিশে জিনিস-পত্রের দাম মনে নেই কিন্তু ৫২/৫৩ সালের কথা মনে আছে , তখন অল্পসল্প দোকান বাজার করছি ১০ বছর বয়সে । মনে আছে একমন চালের দাম হয়েছিল ১৬টাকা । একমন মানে ৪০ সের, এখনকার সাড়ে সাইত্রিশ কেজি। পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা অনেক পরে বইএ পড়ে ফেলে ভেবেছি আমিও তবে ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি’র দলে ? ‘দমদম দাওয়াই’এর কথা খুব ভালো মনে আছে, সেটা বোধয় আরো পরে ৫৭/৫৮সাল হবে । কৃত্তিম ভাবে মজুত করে, জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিতো মজুতদারেরা । মজুতদারদের বাধ্য করা হতো মজুত মাল বিলি করে দিতে । দমদমে প্রথম হয়েছিল বলে খবরের কাগজে বলতো ‘দমদম দাওয়াই’। তারপর অনেক যায়গায় এইরকম লুটপাট হতো ।

খুব মিছিল হ’ত । একটা স্লোগান খুব মনে আছে মুখে একটা চোঙ্গা লাগিয়ে, একজন বলতো ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ আর বাকি লেকেরা একসঙ্গে বলতো ‘ভুলো মাত, ভুলো মাত’ । ৯/১০ বছরে আমিও দুএকটা এইরকম মিছিলে হেঁটেছিলাম, মনে আছে । বুঝতামনা কিছু, কিন্তু ভালো লাগতো, বেশ উত্তেজনা বোধ করতাম । এই উত্তেজনার মধ্যে চলে এটে১৯৫২র প্রথম সাধারণ নির্বাচন । বলার মত কিছুই মনে নেই । শুধু মনে আছে মা ভোট দিতে গিয়েছিল । যে ইস্কুলে ভোট হচ্ছিল সেখানে যেতে, লোকেরা নাকি বলেছিল আপনার ভোট হয়ে গেছে । অবাক মা বাড়ি ফিরে বলেছিলো ‘আমি ভোট দিলাম না আর বলে দিল ভোট হয়ে গেছে’ ! তো তারপর মা’কে আর কখনো ভোট দেওয়ানো যায় নি । দশবছর বয়সের স্মৃতি চৌষট্টি বছর পরে এইটুকুই মনে আছে । 

বয়স বাড়ে,খবরের কাগজ পড়ি । দৈনিক বসুমতি নেওয়া হত বাড়িতে । খুব মিছিল মিটিং হতো । শুনতাম । একজনের নাম খুব শুনতাম । বুঝি না বুঝি তাঁর মিটিংগুলো আমাকে টানতো । জ্যোতি বসু । আমাদের এলাকারই এম এল এ । মিটিংএর ভাষণ তত বুঝতাম না । কিন্তু তার বলার আগে ছোট ছোট নাটক আর গান হত , বেশ উদ্দীপনা লাগতো । গান গাইতো গণনাট্য সঙ্ঘের লোকেরা । তারও আগে, মনে আছে একটা অনুষ্ঠানে শম্ভু মিত্রর নিজকন্ঠে ‘মধু বংশীর গলি’ আর শম্ভু ভট্টাচার্যর ‘রানার’ ব্যালে নাচ দেখেছিলাম । ছাড়া গরুর মতো ঘুরছি । অবশ্য স্কুলেও যেতাম । জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে, বাজার করার টাকা থেকে হাতসাফাই করে ছ আনা পয়সা জমলেই সিনেমা দেখতে ছুটতাম । পাঁচ আনায় সবচেয়ে কম দামের টিকিট আর চার পয়সায় উত্তরপাড়ায় যাওয়া আসার নৌকার ভাড়া । কিংবা বালির ব্রীজ দিয়ে হেঁটে । বালির ব্রীজ (তখন নাম ছিল ওয়েলিংডন ব্রীজ) পেরনোর জন্য দু পয়সা টোল ট্যাকস লাগতো । ১২/১৩ বছর বয়স থেকেই সিনেমা দেখার খুব নেশা হয়েছিল আর নেশা ছিল গান শোনা । খুব গানের জলসা হতো, হেমন্ত মুখার্জী বোম্বাই থেকে গান গাইতে আসতেন ।  আর তখনকার সব ছোট বা বড় জলসায় জহর রায়,ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়দের হাস্যকৌতুক হ’ত । আট আনা বা একটাকার টিকিট কাটার পয়সা পাবো কোথায় ? চট ঘেরা প্যান্ডালের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতাম । অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে মাথায় একটা চাঁটি মেরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতো । দুপয়সা পেতাম জল খাবারের জন্য । এক পসার মুড়ি আর এক পয়সার মুড়কি । বাজার করার খুব উৎসাহ ছিল কারণ দু এক পয়সা বাঁচিয়ে নিজের পকেটে ঢোকাতে পারতাম । সেইজন্যই বোধয় মনে আছে একটাকা দিতো বাজার করতে । ছ’আনায় মাছ নিতাম, দেড়পোয়ার মত মাছ কিনতাম মনে হয় । বাকি দশ আনায় অন্য সবজি কিনে চা্র পাচ পয়সা ফেরত দিতাম ।

১৯৫৭র এপ্রিল থেকে টাকা পয়সা, ওজন এইসবের জন্য দশমিক পদ্ধতি চালু হল। মানে, এক,দুই পয়সা, এক আনা, চার আনা, আট আনা, আর ষোল আনায় একটাকার বদলে একশ’ পয়সায় একটা টাকা,আর ছটাক, পোয়া, সের উঠে গিয়ে কিলোগ্রাম চালু হ’ল । চালু হওয়ার পর অনেক দিন বলতাম নয়া পয়সা ।

পড়াশুনায় খুব আহামরি ছাত্র ছিলাম না । নাটক, আবৃত্তি , দেওয়াল পত্রিকা এইসব করছি, গর্কির ‘মা’ পড়ে নিয়েছি ক্লাস এইটএ, উৎপল দত্তর ‘অঙ্গার’ দেখা হয়ে গেছ, প্রথাগত পড়াশুনায় আর কতটা ভালো হওয়া যায় ! কিন্তু স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাটা পাশ করে গেলাম । পরীক্ষার দিন পনেরো আগে পক্স বেরোলো , আমি বিছানা নিলাম । পরীক্ষা কি করে দেবো ভেবে কান্নাকাটি করলাম । সাগর দত্ত হাসপাতালে সিক বেডে পরীক্ষার ব্যবস্থা হ’ল । ব্লিচ করা খাতায় পেন্সিলে লিখতে হল । পাশ করে প্রি-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজে । তখন উচ্চ মাধ্যমিক চালু হয় নি । দশ ক্লাস পাশ করেই কলেজ । স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর থেকেই চাকরির চেষ্টা চালাতে লাগলাম । তখন সরকারি চাকরী পাওয়ার বয়স সীমা ছিল ২৩ বছর । একদিন দেখলাম খবরের কাগজে রেলে প্রচুর লোক নেওয়ার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে । দুটাকা দিয়ে একটা ফর্ম কিনে ভর্তি করে বসে থাকলাম । পরীক্ষার ডাক এলো । কিন্তু পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেলো । পরীক্ষা ছিল মির্জাপুর স্ট্রীটের সিটি কলেজে । মনে আছে সেদিন খুব দাঙ্গা হয়েছিল । সিটি কলেজ থেকে শিয়ালদহ আসার পথে দেখেছিলাম হ্যারিশন রোডের অনেক দোকান আগুনে জলছিল । কিছু দোকানের সাটারে খড়ি দিয়ে লেখা ছিল হিন্দুর দোকান । সেগুলোয় আগুন লাগে নি । পরীক্ষা পিছিয়ে পরের রবিবার হয়েছিল । দিলাম । ইনটারভিউএ ডাকলো, দিলাম । তারপর তিনবছর পরে চাকরির চিঠিটাও এসে গেলো । মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে রেলের একাউন্টস ক্লার্কের পদে চাকরির ডাক পেলাম  ১৯৬৪র নভেম্বরে । তখন বিকম পার্ট ওয়ানটা পাশ করেছি, পার্ট টু দিয়ে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করা গেলোনা (পরে চাকরী করতে করতে পরীক্ষা দিয়েছিলাম)। একটা তেরো টাকা দামের রেক্সিনের স্যুটকেশ, একটা সতরঞ্চি সঙ্গি করে রওনা দিলাম নতুন জীবনের ডাকে সাড়া দিয়ে ।